বিলপাড় থেকে যখন ফিরলাম, রাত বেশ গভীর হয়ে এসেছে। গ্রীষ্মের রাত। সারা দিন রোদের উত্তাপে জ্বলতে থাকা পৃথিবী এখন একটু একটু করে শান্ত হয়ে আসছে। উঠোনের মাঝে বসে বৌদি সেলাইয়ের কাজ করছে। চাঁদের আলোয় তার মুখখানা যেন ভিজে উঠেছে শুভ্র জ্যোৎস্নায়। গরমে তার কপালে হালকা ঘাম জমেছে, চিকচিক করছে সেই মুক্তোর মতো বিন্দু।
বৌদি একটা সাদা শাড়ি পরে আছে, যদিও সমস্ত শরীরটাই বস্ত্রে ঢাকা, তবু যেন চাঁদের আলোয় তার শরীরের সূক্ষ্ম আবেগী রেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার ঘন চুলগুলো এলোমেলো ভাবে খোঁপা করে বাঁধা, কিছু চুল খসে এসে ঘাড় ছুঁয়ে আছে, কাঁধে নেমে এসেছে। যেন রাতের আঁধারে অজস্র কালো স্রোত।
আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম তাকে। চাঁদের আলোয় তার মুখের মাধুর্য্যে এক অপূর্ব কোমলতা এনেছে। সেই মুখে যে স্নেহ, যে মমতা — তা যেন সমস্ত জগৎ থেকে আলাদা করে তুলেছে বৌদিকে। মনে হচ্ছিল, যত দুঃখ-কষ্ট থাকুক, এই মুখের সামনে সব ফিকে হয়ে যাবে।
আমায় দেখে বৌদি মৃদু কণ্ঠে বললো, “এত দেরি করলি যে? চিন্তা হচ্ছিলো তো…”
আমি মাথা নিচু করে বললাম, “একটু বসেছিলাম বিলের ধারে। সময়ের ঠিক ছিলো না।”
সে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। সেই হাসিতে কি যেন ছিলো — এক অনুচ্চারিত মমতা, এক গভীর স্নেহ। আমি বৌদির সামনে গিয়ে বসলাম। কিছু একটা বলতে চেয়েও থেমে গেলাম। মনের মধ্যে এখনও অপরাধবোধের ঘূর্ণি চলছে। বৌদিকে, যে কিনা আমার মায়ের মতো, তাকে নিয়ে আজ বিকৃত ভাবনা ভেবেছিলাম! লজ্জায় মুখ তুলতে পারছিলাম না।
ভাব কিছুটা সমলে নিয়ে বললাম,- “বৌদি, তুমি এতো গরমে এইসব… এই কাজগুলো পরে করতে পারো তো!”
বৌদি হাসতে হাসতে সেলাইয়ের সুচটাকে কাপড়ের কোলে গুঁজে রাখলো।
তার এই সামান্য গতিতেও বুকের উপর আঁচলটা একটু সরে গেলো — তাতে যে নরম আবছা রেখা ফুটে উঠলো, তা দেখে চোখ ফেরাতে পারলাম না। মনের মধ্যে কীসের যেন ঢেউ উঠলো। আমি নিজেকে সামলে নিলাম। না, না, এসব ভাবা উচিত না।
বৌদি বললো- “গরম থাক বা ঠান্ডা, সংসার তো থেমে থাকে না রে। কাল সকালেই একটা অর্ডার ডেলিভারি দিতে হবে।”
আমি মৃদু হেসে বললাম,- “তুমিই বা কত করবে? সব কাজের বোঝা কাঁধে নিয়েছো। কিছু আমাকেও করতে দাও না!”
বৌদি মৃদু হাসলো, মুখে সেই চিরচেনা স্নেহ, যেন মা তার ছেলেকে আদর করছেন।
“তুই লেখাপড়া করিস। এসব ঝুটঝামেলায় জড়াস না। তোর জন্যই তো সব কষ্ট করছি।”
আমি একটু হাসলাম, তারপর বললাম- “আমি এখন লেখাপড়া আর কাজ দুটোই করবো। তুমি তো একা সব কিছু কুলিয়ে উঠতে পারছো না। আমারও কিছু করা উচিত।” বৌদি এক মুহূর্ত চুপ করে থাকলো। তার চোখে-মুখে আবেগের ছায়া ফুটে উঠল। গ্রীষ্মের সেই জ্যোৎস্নার মতই তার মুখের ওপর এক আশ্চর্য কোমল দ্যুতি ছড়িয়ে পড়লো।
আমি হালকা মজা করে বললাম,- “তবে একটা কথা বৌদি, অন্য কাজ না পেলে তোমার সিলাই এর কাজেই লেগে পড়বো। তাতে তোমার কাজের কোয়ালিটি বাড়বে !”
বৌদি একটু ঠাট্টার ছলে বললো,- “তোর তো মুখেই বাহাদুরি, কোয়ালিটি বাড়বে না ঘোড়ার ডিম হবে!”
দুজনেই একটু হেসে উঠলাম। সেই হাসির মাঝেও যেন এক অদ্ভুত মধুরতা ছড়িয়ে ছিল। কোথাও যেন একটা অব্যক্ত আকাঙ্ক্ষা, অমলিন টান। তবে সেই টান কেবল অন্তর্লীন; প্রকাশের কোনো চেষ্টা নেই।
সেই সময় বৌদি বললো- “চল, খেয়ে নে। তারপর কাজের কথা ভাবা যাবে।”
আমি চুপচাপ তার পেছন পেছন ঘরের ভেতর ঢুকলাম। বৌদি প্লেটে ভাত, ডাল, কিছু ভাজি তুলে দিলো।
আমি খেতে খেতে বললাম- “তুমি একা এত কিছু সামলাও কিভাবে বলো তো? এখন আবার সেলাইয়ের কাজ বাড়ানোর কথা বলছো। এবারে একটু গম্ভীর ভাবে বলার চেষ্টা করলাম, আচ্ছা আমি কি কিছুই সাহায্য করতে পারি না?
বৌদি মাথা নাড়লো, চোখে এক মায়াময় গাম্ভীর্য। বৌদি বললো- “সংসারের দুঃখ, দারিদ্র্য… তাও সহ্য করা যায়। যদি কেউ পাশে থাকে, তখন কষ্টটাও হালকা লাগে রে। তুই যে কথাটা বললি ওটুকুই যথেষ্ট। তোর কাজ করা লাগবে না।”
আমি থেমে গেলাম। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম যেন। মনে হচ্ছিল, এই ঘরের ভিতর, এই শান্ত বাতাসে, এই মৃদু গরমে, বৌদির উপস্থিতি ছাড়া কিছুই বাস্তব নয়। আমি চোখ তুলে তাকালাম — স্রেফ তাকালাম, বললাম না কিছুই। এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা কি মা ছাড়া আর অন্য কেউ হৃদয়ে ধারন করতে পারে?
আমি আবার মাথা নীচু করে খেতে শুরু করলাম।
খাওয়া সেরে আমি নিজের ঘরে চৌকির উপর বসে আছি।মোবাইলে কিছুক্ষণ ফেসবুক স্ক্রল করলাম — তারপর নিজেই বিরক্ত হয়ে ফোনটা বন্ধ করে পাশে রাখলাম। ঠিক তখন বৌদি ঘরে এলো। হাতে মশারি। চুপচাপ, নরম পায়ে হাঁটা। তার মুখে যেন কোনো বিশেষ অনুভূতির ছাপ নেই — এক ধরনের গৃহস্থলির স্বাভাবিক নিষ্পৃহতা। তার চালচলনে, ব্যবহারে একটা দায়িত্বের ছাপ।
বৌদি মশারি টাঙাতে লাগলো। আমি উঠে দাঁড়ালাম, “আমি ধরবো?”
বৌদি মাথা নেড়ে বললো,- “না, তুই বস। তোকে আর মাতব্বরি করতে হবে না।”
তার গলায় কোনো আদিখ্যেতা নেই, কোনো বিশেষ নাটকীয়তা নেই। যেন প্রতিদিনের মতো কাজ শেষ করার একটা অভ্যাস। একটানা, নির্লিপ্ত।
আজ সেলাইয়ের কাজ ছিলো বেশি। কাল সকালে কিছু কাপড় ডেলিভারি দিতে হবে। বৌদিকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম- “বৌদি, ভাবছি ছোটখাটো টিউশনি পড়াতে শুরু করবো।”
বৌদি গম্ভীর গলায় বললো,- “তুই এখন পড়াশোনায় মন দে। চাকরি পেয়ে যদি নিজেকে দাঁড় করাতে পারিস, সেটাই হবে আমার জয়। তোর দাদা বেচে থাকলে কী তুই এইসব ভাবতিস?”
এই দাদার কথাটা যেন হাওয়ার একটা ঝাপটা হয়ে আমার বুকে এসে লাগলো। মুহূর্তে মনে পড়ে গেলো — এই বাড়িতেই দাদা ছিলো একদিন। এখন দাদার স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নেই।
আমি মাথা নিচু করে থাকলাম।
বৌদি বললো- “আমি ঠিক আছি। তুই নিজের কথা ভাব। সংসারের কথা ভাবার সময় তোর এখনও হয়নি।”
আমি কিছু বলতে পারলাম না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বৌদি বললো- “ঘুমা। সকালে উঠে পড়তে বসবি।”
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। বৌদি চলে গেলো তার ঘরের দিকে।
আমি বিছানায় ঢুকে মশারির ভেতর শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করলাম, আবার খুললাম। মোবাইলের স্ক্রিন এখনো জ্বলছিলো। তুলে দেখলাম — কিছু নোটিফিকেশন। কেটে দিলাম। আজ কোনো শব্দ, কোনো চকমক আলো ভালো লাগছে না আর।
চোখ বন্ধ করতেই মন আবার ফিরে গেল সন্ধ্যার স্মৃতিতে। বিলের ধারে যখন বসে ছিলাম, তখন সেই জোৎস্নালোকিত প্রকৃতির বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের কাছে বৌদির রূপ যেন অনাহুত, ক্ষীণ মনে হয়েছিল। গ্রাম্য প্রকৃতি — তার স্নিগ্ধতা, প্রশান্তি আর বিশুদ্ধতা হৃদয়কে শান্ত করেছিল; আর বৌদির রক্তমাংসের শরীর, তার উষ্ণ সৌন্দর্য, এক অন্যরকম তীব্র আকর্ষণ জাগিয়ে মনের স্থৈর্য ভেঙে দিয়েছিলো। তাই বৌদির রূপ অতি তুচ্ছ বলে মনে হয়েছিলো। কিন্তু এ কি সমস্ত সত্যের একমাত্র দিক? বাইরের রূপ কি সব?
আমার প্রতি বৌদির যে নিঃস্বার্থ স্নেহ, তা কি অন্তরের গোপন সৌন্দর্যের নয়নাভিরাম প্রতিচ্ছবি নয়? নিজের সন্তান না হয়েও যে অশেষ সহ্যশক্তি নিয়ে আমাকে আগলে রেখেছে, তার মধ্যে যে নিঃশর্ত মমতার ধারা প্রবাহিত হয়, তা কি তাকে আরও অনুপম করে তোলে না?
ছোটবেলা থেকে দেখে আসা সেই স্নেহময়ী বৌদি আজ যেন সত্যিকার অর্থে এক জীবন্ত সৌন্দর্যের মূর্তি হয়ে উঠেছে। বিলের অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্যও ম্লান হয়ে আসে বৌদির মাতৃত্বের কোমল ছায়ার সামনে।
প্রকৃতির সৌন্দর্যে প্রশান্তি আছে বটে, কিন্তু বৌদির মধ্যে যে বাৎসল্য প্রেমের ধারা প্রবাহিত হয় তা প্রকৃতির মাঝে অনুপস্থিত। প্রকৃতি হৃদয়কে শান্ত করে, অথচ বৌদির স্নেহ হৃদয়কে গভীরতায় ভরিয়ে তোলে, এক অন্তরঙ্গ আশ্রয়ের অনুভূতি জাগায়। ভাবলাম, বৌদির কাছ থেকে পাওয়ার মতো যদি কিছু থাকে, তা এই নিখাদ স্নেহ, এই মায়াবী সুরক্ষা। সন্ধ্যায় মন যেটুকু কলুষিত হয়েছিল, তা ছিল সাময়িক দুর্বলতা। সেটাকে আমি আর বড় করে দেখবো না। কারণ, যদি সে দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিই, তবে হয়তো চিরকালের জন্য হারাতে হবে আমার এই অমূল্য স্নেহময়ী মা’কে। এইসব ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।