নতুন জীবন – ৫৬

This story is part of the নতুন জীবন series

    পরদিন দুধ বিক্রি করে এসে সাগ্নিক স্নান করে খেয়ে শুয়েছে, এমন সময় রিতু এলো সাগ্নিকের দরজায়। অনেক ডাকাডাকি কাকুতি মিনতি করলেও সাগ্নিকের ইচ্ছে হলো না দরজা খুলতে। একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না সাগ্নিক। নিশব্দে পরে রইলো বিছানায়। রিতু মিনিট কুড়ি পর চলে গেলে ঘুমিয়ে পরলো সাগ্নিক। প্রচন্ড ক্লান্ত সে মানসিকভাবে। গতকাল ঘুমাতে পারেনি সারারাত। হঠাৎ ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙলো। পাওলার নম্বর থেকে কল। আজ সেই ফোনটাও ধরতে ইচ্ছে করছে না সাগ্নিকের। কিন্তু টানা তিনবার ফোন আসায় রিসিভ করলো সাগ্নিক। ফোনের ওপারে মৃগাঙ্কীর ক্রন্দনরত গলা শুনে ঘুম নেমে গেলেও সাগ্নিকের। মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠান্ডাস্রোত বয়ে যাওয়া অনুভব করতে পারলো সে।
    সাগ্নিক- মৃগাঙ্কী? কি হয়েছে তোমার?
    মৃগাঙ্কী- আঙ্কেল, তুমি কোথায়?
    সাগ্নিক- ঘরে আছি। কেনো?
    মৃগাঙ্কী- বাবা-মা এর প্রচন্ড ঝগড়া হয়েছে। বাবা মা’কে মারতে এসেছে। তারপর বাবা বেরিয়ে গিয়েছে।
    সাগ্নিক- এখন তোমার মা কোথায়?
    মৃগাঙ্কী- মা টয়লেটে। মা আমাকে নিয়ে পাটনা চলে যাচ্ছে। প্লীজ আঙ্কেল তুমি কিছু করো। আমার খুব ভয় করছে।
    সাগ্নিক- পাটনা? কে আছে ওখানে?
    মৃগাঙ্কী- একটা আন্টি আছে। আঙ্কেল আমি পাটনা যাবো না।
    সাগ্নিক- কিসে যাবে জানো?
    মৃগাঙ্কী- বাসে যাবো। মা কথা বলেছে। বাসের টিকিট শুনেছি
    সাগ্নিক- শোনো মৃগাঙ্কী। কান্না থামাও। মায়ের কথা শোনো। মা তোমার ভালো চায়। মায়ের পাশে থাকো। আমি তোমার পাশে আছি সবসময়। তুমি সবসময় আঙ্কেলকে পাশে পাবে।
    মৃগাঙ্কী- আমি রাখছি।

    সাগ্নিক ফোন রেখে তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। এখন ৫ টা বাজে। তাড়াতাড়ি নিজের ছোটো করে ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। সে জানে তার কি কর্তব্য। ব্যাগ গুছিয়ে, টাকা পয়সা নিয়ে সাগ্নিক বাস টার্মিনাসে এসে হাজির হলো। সাড়ে ছ’টায় পাটনার বাস আছে। সাগ্নিক ওয়েট করতে লাগলো। ছ’টা দশে পাওলাকে দেখলো মৃগাঙ্কী আর ব্যাগ নিয়ে টার্মিনাসে ঢুকতে। মৃগাঙ্কীর চোখে জল। জল পাওলার চোখেও, কিন্তু জলে মিশে আছে রাগ, ঘৃণা আর যন্ত্রণার ছবি। সাগ্নিক পাওলার সামনে এসে দাঁড়ালো।
    পাওলা- তুমি?
    সাগ্নিক- আমি।
    পাওলা- কি করছো এখানে?
    সাগ্নিক- পাগলামি কোরো না।
    পাওলা- শোনো সাগ্নিক। জীবনটা আমার। তাই সিদ্ধান্তও আমার। প্লিজ সিন ক্রিয়েট কোরো না।
    সাগ্নিক- করছি না। মৃগাঙ্কী ভয় পেয়ে আমাকে কল করে। আজ তোমার যা মানসিক পরিস্থিতি, আমারও তাই। বেইমানি দু’জনের সাথেই হয়েছে!
    পাওলা- তাই তুমি চাইছো আমি তোমাকেও নিয়ে যাই? নাকি বাপ্পার সাথে আমার খারাপ সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে নিজের আখের গোছাতে চাইছো?
    সাগ্নিক- আমি চাই না তুমি আমাকে নিয়ে যাও। মৃগাঙ্কী ভয় পেয়ে কল করেছে বলেই আমি এসেছি। ভেবেছি আটকাবো। কিন্তু এখন বুঝছি, না আটকানোটাই ভালো।
    পাওলা- বাহ্। বুঝেছো যখন, তো রাস্তা ছাড়ো আমার।
    সাগ্নিক- তুমি যাও। তোমার ব্রেকের প্রয়োজন আছে। কিন্তু মৃগাঙ্কীকে নিয়ে। এভাবে একা। দেখো আমি চাইনা তোমাদের কোনো ক্ষতি হোক। তোমরা যাচ্ছো। যাও। আমিও যাবো।
    পাওলা- অধিকার ফলাতে এসো না সাগ্নিক।
    সাগ্নিক- অধিকার ফলাচ্ছি না। আমি স্বয়ংসম্পূর্ণ একজন মানুষ। আমি যেখানে ইচ্ছে যেতে পারি। আমার ইচ্ছে হয়েছে, তাই আমি পাটনা যাবো। এই বাসেই যাবো। তোমার সাথে কথা বলবো না। কিচ্ছু না। আমি শুধু বাসে কোনো একটা সিটে বসে থাকবো। কারণ মৃগাঙ্কী খুব ভয় পাচ্ছে।
    পাওলা- মৃগাঙ্কী আমার মেয়ে।
    সাগ্নিক- একদম। কিন্তু ও আমার ছাত্রী, আমার ভাইঝি। ওর রক্ষা করা আমার কর্তব্য। দেখো বৌদি। না কোরো না। আমার এই বাসে পাটনা যেতে তোমার পারমিশনের প্রয়োজন নেই। তবু আমি নিচ্ছি। আমি কথা দিচ্ছি গোটা রাস্তায় একটা কথাও বলবো না। এক কোণে পরে থাকবো। তোমরা নিরাপদে পৌঁছে গেলে ফিরে আসবো। মৃগাঙ্কীর জন্য আমায় এটুকু করতে দাও।
    পাওলা- ওকে।

    সাগ্নিক টিকিট কাউন্টারের দিকে যেতে উদ্যত হলে পাওলা ডাকলো।
    পাওলা- কোথায় যাচ্ছো?
    সাগ্নিক- টিকিট কাটতে।
    পাওলা- প্রয়োজন নেই। আমি থ্রি সিটার কেটেছি যাতে দুজনে আরামে যেতে পারি। কিন্তু মৃগাঙ্কী যখন তোমাকে এভাবে ফোন করেছে, তখন আমি মনে করি তুমি আমাদের সাথে গেলেই ও খুশী হবে। ওর খুশীটাই সব এখন আমার কাছে। ওর জন্য, শুধুমাত্র ওর জন্য আমি তোমাকে অ্যালাও করছি।

    সাগ্নিক পাওলার ব্যাগপত্র সব দায়িত্ব সহকারে তুলে নিলো। সাগ্নিককে পাওলা আসার পারমিশন দেওয়ায় প্রথম মৃগাঙ্কীর মুখে হাসি দেখলো পাওলা। মেয়ের মুখে হাসি দেখে একটু হলেও যেন সুখ পেলো পাওলা। সাগ্নিকের কোলে বসে অন্ধকার হয়ে শহরতলীর ছোটো ছোটো আলো আঁধারির খেলা দেখতে লাগলো মৃগাঙ্কী। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো পাওলা।

    রাতের খাবার খেয়ে তিনজনে সিটে হেলান দিলো। ঘুমিয়ে পরলো মৃগাঙ্কী। কিন্তু পাওলা আর সাগ্নিকের চোখে ঘুম নেই। নিস্তব্ধ রাতে বাস হু হু করে ছুটে চলেছে আর সাগ্নিক তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে বাসের ছাদের দিকে। পাওলাও শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। ঘুমাতে ঘুমাতে মৃগাঙ্কী একটা সময় পাওলার শরীরে ঢলে পরলো। মেয়ের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে নিশব্দে কেঁদে চললো পাওলা।

    বাসের দুলুনিতে চোখটা হালকা লেগে এসেছিলো সাগ্নিকের। হঠাৎ কাঁধে স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভাঙলো। পাওলা তার কাঁধে মাথা দিয়েছে। সাগ্নিক পাওলার দিকে তাকালো।
    পাওলা- থ্যাংক ইউ। সাথে আসার জন্য।
    সাগ্নিক- ঘুমাও। তোমার রেস্ট দরকার।
    পাওলা- রেস্ট না৷ আমার সাপোর্ট দরকার। আমি আমার লড়াই চালিয়ে যাবো। তুমি শুধু পাশে থেকো এভাবে। আমি সব জানি তোমার সম্পর্কে। কিন্তু তুমি আমার কাছে ওসব কিচ্ছু পাবেনা যা তুমি বহ্নিতা বা অন্য কারো কাছে পাও। আমি পারবো না ওসব কোনোদিন। কিন্তু তবু আমি চাইবো তুমি আমার আর মেয়ের পাশে থাকো।
    সাগ্নিক- মৃগাঙ্কীর পাশে আছি সারাজীবন। তোমার পাশেও। আর যা জেনেছো জেনেছো৷ ধরে নাও সেটা আমার অন্য জীবন। ওউ জীবনে তুমি আমাকে চেনো না।
    পাওলা- থ্যাংক ইউ সাগ্নিক।
    সাগ্নিক- পাটনায় কোথায় যাচ্ছো?
    পাওলা- আমার বান্ধবী আছে। সিঙ্গেল মাদার। ওখানে থাকবো।
    সাগ্নিক- কতদিন?
    পাওলা- জানি না। তবে যদি কখনও প্রয়োজন হয়। আমি তোমাকে কল করবো। আসবে তো?
    সাগ্নিক- নিশ্চিত থাকো।

    কৃতজ্ঞতায় পাওলার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এলো। সেই জল চোখ বেয়ে সাগ্নিকের শার্ট বেয়ে কাঁধ ভিজিয়ে দিলো। হু হু করে উঠলো সাগ্নিকের ভেতরটা।
    পাওলা- কত অপারগ না আমি?
    সাগ্নিক- অপারগ?
    পাওলা- হ্যাঁ। রূপ, যৌবন সব থাকা সত্বেও আমার বর চুরি হয়ে যায়। চুরি হয়ে গেলো।
    সাগ্নিক- প্লিজ। ওসব ভেবো না। তুমি তোমার জায়গায় ঠিক। বাপ্পাদার চরিত্রের অবনমন হয়েছে। তার দায় তুমি কেনো নিচ্ছো?
    পাওলা- কারণ আমি অপারগ।
    সাগ্নিক- তুমি ভেঙে পরলে চলবে না৷ মৃগাঙ্কী তোমার হৃদস্পন্দন। তুমি ভেঙে পরলে ওর কি হবে।
    পাওলা- হৃদয় যখন ধরে রাখতে পারিনি, তখন কি আর হৃদস্পন্দন আমার থাকবে ভাই?
    সাগ্নিক- থাকবে। বিশ্বাস রাখো।

    অসীম দুঃখের সমুদ্রে ভেসেও আস্তে আস্তে দু’জনে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো।

    পরদিন পাটনা পৌঁছে পাওলা আর মৃগাঙ্কীকে পাওলার বান্ধবীর বাড়িতে পৌঁছে দিলো সাগ্নিক। কিছুক্ষণ বসে টিফিন করে সাগ্নিক বেরোতে উদ্যত হলো। সাগ্নিকের প্রতি কৃতজ্ঞতায় পাওলার দু-চোখ জলে ভরে এলো।
    সাগ্নিক- কেঁদো না। আমাকে পাশে পাবে, যখনই ডাকবে।
    পাওলা- তুমি কি করে থাকবে ওখানে?
    সাগ্নিক- বুকে পাথর রেখে।
    পাওলা- আমি স্বার্থপর জানো তো। নিজের স্বামীর সত্য খোঁজার খেলায় তোমার জীবনটাও আমি তছনছ করে দিলাম।
    সাগ্নিক- তছনছ করেছো? নাকি তছনছ হওয়া থেকে বাঁচিয়েছো?
    পাওলা- তুমি এখন খাবে কোথায়?
    সাগ্নিক- আমি রান্নার জিনিসপত্র কিনেছি।
    পাওলা- রাঁধতে পারো?
    সাগ্নিক- না। শিখছি। শিখে নেবো।
    পাওলা- আমার এখন ওখানে থেকে তোমাকে রেঁধে খাওয়ানো উচিত ছিলো।
    সাগ্নিক- আমায় নিয়ে ভেবো না। আমি মানিয়ে নেবো।
    পাওলা- বাপ্পাকে বোলো না তুমি এখানে রাখতে এসেছো।
    সাগ্নিক- ফোন করেনি তো। আমি ভেবেছিলাম রাতে ফোন করবে।
    পাওলা- হম। হয়তো রাতে বাড়ি ফেরেনি। নিজের নতুন বউয়ের কাছে গিয়েছে।

    কথাগুলো বলতে পাওলার বুক ফেটে গেলেও বলতে পারলো।
    সাগ্নিক- আমি আসি। তোমার লোকেশন গোপন রাখতে আমার তাড়াতাড়ি শিলিগুড়ি ফেরা উচিত।
    পাওলা- এসো। আর বহ্নিতাকে বোলো। ও প্রেগন্যান্ট। ওকে ওই কারণে জানাইনি। তুমি জানিয়ে দিয়ো। নিজের মুখে নিজের স্বামীর কুকীর্তি বলতে পারবো না আমি।
    সাগ্নিক- তুমি সব ভুলে মৃগাঙ্কীর খেয়াল রাখো। আসছি।

    সাগ্নিক ওদের ছেড়ে বেরিয়ে এলো।
    ফেরার বাসে উঠে বসেছে, এমন সময় বাপ্পাদার ফোন।
    বাপ্পাদা- সাগ্নিক, তুমি কোথায়?
    সাগ্নিক- দাদা, আমি আর্জেন্টলি একটু বাইরে এসেছি।
    বাপ্পা- বাইরে বলতে?
    সাগ্নিক- মুর্শিদাবাদ।
    বাপ্পা- মুর্শিদাবাদ?
    সাগ্নিক- হ্যাঁ। তোমাকে বলেছিলাম না আইসা ম্যাডামের কথা? উনি ওনার কোম্পানিতে চাকরির কথা বলেছিলেন।
    বাপ্পা- হ্যাঁ হ্যাঁ।
    সাগ্নিক- তাই উনি এখানে পাঠিয়েছেন। মালিক যিনি আছেন, তিনি মুর্শিদাবাদ ইউনিটে এসেছিলেন। দেখা করতে পাঠিয়েছেন ম্যাডাম। হঠাৎ কল আসায় আর জানাতে পারিনি।
    বাপ্পা- ওকে। আসলে পাওলা বাড়িতে নেই।
    সাগ্নিক- হোয়াট? কখন থেকে?
    বাপ্পা- জানিনা। কাল আমি বাড়ি ফিরিনি।
    সাগ্নিক- মানে? মৃগাঙ্কী কোথায়? কাল ফেরোনি মানে? এখন দুপুর দুটো বাজে দাদা। তুমি সকালেও ফেরো নি?
    বাপ্পা- না। তুমি তো জানোই সব৷ কি হয়েছে। তুমি জানো ওরা কোথায়?
    সাগ্নিক- দাদা, কি বলি আমি। আমি জানি না।
    বাপ্পা- তোমাকে ফোন করেনি পাওলা?
    সাগ্নিক- না।
    বাপ্পা- আমি তোমাকে ঠকিয়েছি, পাওলাকে ঠকিয়েছি, মৃগাঙ্কীকে ঠকিয়েছি।
    সাগ্নিক- দাদা, ভেঙে পোরো না। আমি রাতে ফিরবো। কাল সকালে আমি তোমার সাথে দেখা করছি।

    সাগ্নিক ফোনটা কেটে দিলো। এক অসহ্য যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খেতে লাগলো। বাসের জানালা দিয়ে আসা হু হু হাওয়া চোখের জল উড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগলো সাগ্নিকের।

    চলবে….
    মতামত জানান [email protected] এ মেইল করে অথবা hangout এ মেসেজ করুন এই মেইল আইডিতেই। আপনাদের মেইল পেলে লেখার উৎসাহ আসে। পরিচয় গোপন থাকবে।