এলাকার একটি বাড়ি, যার ঠিকানা ১১/বি, বি কে পাল অ্যাভেনিউ। তার সামনে গাড়িটা এসে থামলো। মাধবী একবার বিমলের দিকে তাকালো। বিমলের চোখ ছিল উইন্ড গ্লাসে, হাত স্টিয়ারিং-এ। সে চাইছিলনা পাশের সিটে বসা মানুষটির চোখে চোখ রাখতে। আজ তার খুব কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট হলেও তা সহ্য করতে হবে। কারা যেন বলে, কষ্ট করলে কেষ্ট পাওয়া যায়! সেও তো একটা কেষ্টই চায়।……
“শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি, তুমি সত্যি চাও এটা হোক?”
“হুম!”
সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে আর কথা না বাড়িয়ে মাধবী গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। পিছন ফিরে তাকালো না। বিমলও জানে এখানে আর এক মুহূর্তও থাকা শ্রেয় নয়। সেও সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির স্টার্ট দিল। ধোঁয়া উড়িয়ে বি কে পাল সরণি দিয়ে বেরিয়ে গেল।
কলিং বেল বাজলো, “টিং টং….”
সমরেশ গিয়ে দরজাটা খুললো। অপেক্ষার অবসান হয়েছে। মাধবী দাঁড়িয়ে রয়েছে দোরগোড়ায়।
“ভেতরে এসো….”
কুন্ঠিত অবস্থায় মাধবী পদার্পণ করলো। সমরেশ দোর দিয়ে দিল। বসতে বললো তাকে। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে অতিথির জন্য শরবত বানিয়ে আনলো। হাসি মুখে মাধবী তা গ্রহণ করলো।
“বিমল এলনা?”
“ওর কি আজ আসার কথা?”
“তাও ঠিক। তবে একবার দেখা করে যেতে পারতো।”
“লজ্জায় আসেনি….”, মাধবীর গলায় হতাশার ছাপ।
“ওই বা কি করবে! এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন কোনোদিন যে হতে হবে তা কি সে পূর্বে কখনো কল্পনা করেছিল….”, সমরেশ তার বন্ধুর স্বপক্ষে নিস্তেজ যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করলো।
“আচ্ছা সমরেশ দা, আপনি বিমলের জায়গায় থাকলে কি করতেন?”
“আমি??…. জানিনা…. একজন তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে তুল্যমূল্য করাটা খুব সহজ কিন্তু যার উপর দিয়ে ঝড় যায় সেই একমাত্র বোঝে….”
“আপনি তো আর এখন তৃতীয় ব্যক্তি নন। বরং এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আপনিই এক এবং একমেব!”
“মাধবী….”
“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছি। বুকে পাথর রেখে বাস্তবটা আমি মেনে নিয়েছি। তাই আর দেরী করা উচিত হবেনা। বলুন কোথায় যেতে হবে? কোন ঘরে?”
“দাঁড়াও, একটু তিষ্ঠ। অত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। এখনও সময় অনেক পড়ে আছে।”
“কিন্তু বিমল যে বলেছে……”
“কি বলেছে?”
“বলেছে যে যতটুকু সময় পাচ্ছ সেটাকে কাজে লাগিয়ে নাও। যাতে আজকেই আমি পরিপূর্ণ হয়ে উঠি”
“সত্যি বিমল যদি জীবন বিজ্ঞানের ক্লাস গুলো মন দিয়ে করতো তাহলে এরকম আলটপকা কথাবার্তা তোমাকে বা আমাকে শুনতে হতো না”
“ওর তো আরো অনেক কিছুই সময় থাকতে করা উচিত ছিল, যা সে করেনি। এখন ভেবে আর কিই বা হবে”
“তা ঠিক বলেছো.. কিন্তু তোমাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে তুমি অতটা প্রস্তুত নও এখনো”
“সে তো এই ব্যাপারে প্রস্তুত আমি কোনোকালেই ছিলাম না। কিন্তু নিয়তির কারণে নিয়োগের স্মরণাপন্ন তো হতে হচ্ছে। ….”
“নিয়োগ?”
“নিয়োগ নয়? তাহলে এটা কি?”
নিয়োগের মানে সমরেশ জানে। জানে সে ইতিহাস, এদেশের রাজা মহারাজাদের। প্রাগৈতিহাসিক কালে বিজ্ঞান অত উন্নত ছিলনা। ছিলনা কোনো বিকল্প ব্যবস্থা সন্তান প্রসবে, যদি পুরুষের বীর্য অক্ষম হত তার নারীর ডিম্বাণুকে সিক্ত করতে। তখন রাজা রাজাধিরাজেরা নিজের বংশ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশস্ত লোক নিয়োগ করতো তাদের রানীদের অন্তঃসত্ত্বা করতে।
আচ্ছা বিমল তবে কোন রাজ্যের রাজা? রাজা নাহলেও বসু মল্লিক বাড়ির বড়ো ছেলে সে। মধ্য-কলকাতায় তাদের খুব নাম ডাক। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে। এখন প্রভাব কমলেও আভিজাত্য যায়নি। বিমলেন্দু, অমলেন্দু , বসু মল্লিক পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের কান্ডারি। অমলেন্দু ওরফে অমল, ছোট ছেলে। বিমলের অনেক পরে তার বিয়ে হয়েছে। অথচ সে আজ এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। কিন্তু বিমল? তার ভাঁড়ার শূন্য। দোষ কার? কার আবার, তার স্ত্রী মাধবীর? এটাই তো সমাজের চল। যত দোষ নন্দ ঘোষ নয়। আসলে উক্তিটি হওয়া উচিত যত দোষ নন্দিনী ঘোষ।
যদিও চিকিৎসা বিজ্ঞান বলেছে, সমস্যা বিমলের রয়েছে, মাধবী সবদিক দিয়ে সুস্থ। তা বিমল জানে, মাধবী জানে, আর জানে শুধু সমরেশ, বিমলের বাল্যকালের প্রিয় বন্ধু, এর ব্যতীত কেউ জানেনা যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ বিশম্বর বসু মল্লিকের পৌত্র বিমলেন্দু বসু মল্লিক আদতে একজন নপুংশক। ছিঃ! জানাজানি হলে লজ্জার একশা। এইভেবেই বিমলেন্দুর দিন কাটতো গভীর আশংকায়। যদি তার পৌরুষত্ব খোয়া যায় সমাজের চোখে?
তাই মা ব্রজবালা দেবীর লাখ বলাতেও সে মাধবীকে ত্যাগ করে অন্যত্র বিয়ের পিঁড়িতে বসেনি। কারণ এই নয় যে সে তার স্ত্রীকে অফুরন্ত ভালোবাসে। ভালোবাসে তো বটেই তবে শুধু সেটা কারণ নয় দ্বিতীয় বিবাহে রাজি না হওয়ার। আসল কারণ হল সে ভালোমতোই জানে যতবারই সে বিয়ে করুক না কেন, তার তরফ থেকে বসু মল্লিক বাড়ি কূল-বংশের কোনো প্রদীপ পাবেনা।
ছোটভাই অমলেন্দু বিয়ে করে বছর ঘুরতে না ঘুরতে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছিল। যৌথ পরিবারে ছোট বউ হয়েও প্রথম সন্তানকে কোলে আনায় রুক্মিনীর মাটিতে পা পড়তো না। দু’বছর পর যখন সে পুত্র সন্তানের জন্ম দিল, তখন সেই হয়ে উঠলো বাড়ির পরবর্তী প্রজন্মের সর্বেসর্বা। মাধবীর সাথে যেন গোটা বসু মল্লিক বাড়ি দুয়ো রানীর মতো ব্যবহার করতে লাগলো। মাধবী তা কিছুতেই মানতে পারছিলো না। সে তো জানে, সে সক্ষম সন্তান প্রসবে। সমস্যা তো তাদের বাড়ির বড়ো ছেলের। কিন্তু মুখ ফুটে তা বলার জো নেই। যতই হোক সেই অক্ষম মানুষটাই তো তার স্বামী।
এদিকে বিমলের উপর অসম্ভব চাপ বাড়তে লাগলো। বাড়িতে একদিন মা তাকে একান্তে ডেকে এনে ফরমান জারি করে দিল, বছর ঘুরতে না ঘুরতে যদি বড়ো বউমা সুখবর না দিতে পারে, তাহলে তাকে বাপের বাড়িতে দিয়ে এসে দ্বিতীয় বিয়ের তোড়জোড় করতে হবে। বিমলের তখন উভয় সংকট। মাধবী এই অপমান সহ্য করবে কেন? বিমলের মতো অভিজাত ধনী পরিবার তার নয়। একবার বিয়ে ভেঙে গেলে সে তো ভেসে যাবে। তার সত্যিই আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না। অগত্যা নিজের বিয়ে বাঁচাতে তাকে এই কঠিন সত্যিটা সকলকে বলতেই হবে যে সমস্যা তার নয় বিমলের রয়েছে। এই সম্ভাবনার আঁচ বিমল পেয়েছিল। তাই সে একটা উপায় বার করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে শুরু করলো। এটা তার মরণবাঁচন বিষয়।
অনেক গবেষণা করে, ইতিহাস ঘেঁটে সে পেল এই বিরল লুপ্ত হয়ে যাওয়া বিকল্প ব্যবস্থা, নিয়োগ প্রক্রিয়া। কিন্তু কে করবে তাকে সাহায্য? কাকেই বা সে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করবে। সবার প্রথমে যার কথা তার স্মরণে এল সে হল তার সঙ্কটমোচন, বাল্যকালের হরিহর আত্মা, সমরেশ সান্যাল। হ্যাঁ, সেই পারে তাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে।
সমরেশকে খুলে বললো সব কথা। বিমল জানালো সে কোনোদিনও বাবা হতে পারবে না। সমরেশ একজন বিপত্নীক মানুষ। ছুটিতে পাহাড়ে পরিবার সমেত ঘুরতে গেছিলো। তখন তার ভরা সংসার। স্ত্রী, দুই কন্যা, এবং বিধবা মাতা। সকলেই চলে গেল, যখন তাদের গাড়িটা গিয়ে পড়লো খাদে। সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্যবশত বলবো তা জানিনা, তবে একজনই প্রাণে বেঁচে ফিরলো, আর সে হলো সমরেশ। তবে থেকে সমরেশ একা, একান্তে দিন কাটাচ্ছে।
সমরেশ যেহেতু দুই সুস্থ কন্যার পিতা ছিল তাই তার সক্ষমতা নিয়ে বিমলের মনে কোনো সংকোচ ছিলনা। তাছাড়া অত বড়ো দুর্যোগ হওয়ার পরও সে নিজেকে ঠিক সামলে নিয়েছিল। দেবদাস হয়ে নেশাভান করে নিজের সুস্বাস্থ্যকে জলাঞ্জলি দেয়নি। সমরেশ বিমলের প্রিয় বন্ধু হওয়ায় মাধবীও ভালোমতো চিনতো। আশা যাওয়া চলতো সপরিবারে একে অপরের বাড়িতে। অবশ্য যতদিন সমরেশের পরিবার ছিল। তারপর সমরেশ বসু মল্লিকদের বাড়িতে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বন্ধুত্বের টানে এবং বন্ধুর পাশে দাঁড়াতে বিমল সস্ত্রীক মাঝেসাঝেই সমরেশের খোঁজ নিতে ওর বাড়িতে হানা দিত।
সমরেশের জন্য মাধবীরও খারাপ লাগতো। বারবার বিমলকে বলতো সমরেশদা-কে বুঝিয়ে আরেকটা বিয়ে করাতে। মজা করে বিমল বলতো তোমার সাথে আমার ডিভোর্সটা হয়েগেলেই আমি তোমাদের চার হাত এক করে দেব। তখন বোঝেনি, খানিকটা হলেও সেই সম্ভাবনা পূরণ হতে চলেছিল। সমরেশ ও মাধবীর মধ্যে বিবাহবহির্ভূত দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে উঠতে যাচ্ছিলো, তাও আবার তা বিমলের নিবেদনেই।
চলবে। ….. লেখায় — মানালী বসু…..