কর্পোরেট ভালোবাসা- তুতীয় পর্ব

আগের পর্ব

এরপর প্রায় তিন বছর পেরিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে রাসেলের বাইং হাউসের বিজনেস খুব ভালোভাবেই দাঁড়িয়ে গেছে। এর কৃতিত্ব অনেকটাই শাবানার। শাবানা এই প্রতিষ্ঠানের প্রাণ। রাসেল নিজের মোবাইলে কিছু ছবি দেখছিলো। এসব একটু আগেই তার ইনস্টাগ্রামে এসেছে। ছবিগুলো দেখতে দেখতে এতোদিন আড়ালে লুকিয়ে থাকা রহস্যের অনেক কিছুই তার কাছে খোলাসা হয়ে গেলো। এসময় শাবানা ওর চেম্বারে ঢুকলো। রাসেলই তাকে ডেকে পাঠিয়েছে।

রহস্যময় মেয়েটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,‘মি.শোয়েব কিছু ছবি পাঠিয়ে মেসেজ করেছে। লিখেছে হি ইজ ফায়ারড্ ফ্রম হিজ অফিস। এমনকি ওর ওয়াইফও তাকে বাসা থেকে বাহির করে দিয়েছে।’ রাসেল শোয়েবের পুরো মেসেজটাই শাবানার মোবাইলে ট্রান্সফার করে দিলো।

বস আরকোনো ব্যাখ্যা চাইলোনা দেখে শাবানাও কিছু বললো না। শুধু বসের চোখের দিকে স্থীর তাকিয়ে রইলো। এরপর রাসেল যখন বললো ‘ঠিক আছে, যাও নিজের কাজ করো’ শাবানা তখন রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। শাবানা চলে গেলে রাসেল বোবাইল থেকে একে একে ছবিগুলি ডিলিট করে দিলো। তারপর চেয়ার ছেড়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। কিছুই দেখছেনা সে, শুধু মেয়েটার কথা ভাবছে। অশ্লীল ছবিগুলো অনেক প্রশ্নের মিমাংসা করে দিলেও জটিল কিছু প্রশ্ন তার সামনে হাজির করেছে। এর উত্তর পেতে হলে শাবানাকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

নিজের চেম্বারে ফিরে এলো শাবানা। না চাইলেও নিজের চেহারায় প্রতিশোধ নেয়ার হিংস্র সন্তুষ্টি ভাব ফুটে উঠছে। বসের শান্ত, নির্লিপ্ত চেহারাও বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। অশান্ত মনটাকে শান্ত করার জন্য সে চোখবুঁজে চেয়ারে বসে রইলো। তিনবছর আগের পুরো অনেক ঘটনাই তার মনে পড়ছে।

দ্বিতীয় দিন শোয়েবের আমন্ত্রণে শাবানা আবারও সেই রেস্ট হাউসে গিয়েছিলো। বিনিময়ে আরও বড় একটা ডীল সাইন করানোর ব্যবস্থা করেছিলো। সেদিন শাবানা বিশেষ প্রন্তুতী নিয়ে গিয়েছিলো। আর শোয়েব নিজের অজান্তেই তার ভবিষ্যত মৃত্যু পরোয়ানায় সই করেছিলো। টেনশনের কারণে শাবানা মাঝেমধ্যে ঘুমের ওষুধ খেতো। তাই ব্যাগে আগে থেকেই স্লিপিং পিল ছিলো। শাবানা শোয়েবের অগোচরে তার ড্রিংকস্-এ সেটা মিশিয়ে দিয়েছিলো। কুত্তাটা গভীর ঘুমে ঢলে পড়লে শাবানা অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় তাকে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছু ছবি তুলে নিয়েছিলো। ঘুমন্ত অবস্থায় ওর ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে মোবাইল আনলক করে তাতে আরো কিছু মেয়ের সাথে শোয়েবের অশ্লীল ছবি আবিষ্কার করেছিলো। শাবানা সেখান থেকেও কিছু ছবি তার মোবাইলে ডাউনলোড করে নিয়েছিলো।

এতো দিন ধৈর্যধরে অপেক্ষা করেছে শাবানা। শোয়েবের সাহায্য ছাড়াই তারা এখন যথেষ্ট অর্ডার সংগ্রহ করতে পারে। তাই সময় বুঝে এবার সে ব্ল্যাকমেইলার জানোয়ারটার কলিজায় প্রতিশোধের পেরেক ঠুকে দিয়েছে। শাবানা তিনচার মাস আগে ফেক আইডি খুলে নারীলোভী শোয়েবের সাথে ফ্রেন্ডশীপ করেছিলো। কয়েকদিন আগে সেই ছবিগুলিই সে শোয়েবের ফেসবুকে পাঠিয়ে দিয়েছে। আর ওখান থেকে অনেকের কাছেই ছবিগুলি শেয়ার হয়ে গেছে। শোয়েবের লাইফে এখন যা ঘটেছে তার জন্য শাবানা নিজেকে এতটুকুও অপরাধী মনে করলো না।

পরবর্তী তিনচার মাস ব্যবসায়িক ব্যস্ততার মধ্যে কাটলো। তবে এর মাঝেও শাবানা টের পেলো যে, বসের কৌতুহলী দৃষ্টি তাকে সারাক্ষণ অনুসরণ করে চলেছে। এবং কিছুদিন পর আরও কয়েকটা বিষয় তার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ালো। চাঁদনী নামের একটা মেয়ে কিছুদিন হলো তাদের বাইং হাউসে পরামর্শ দাতার কাজ শুরু করেছে। নিউজিল্যান্ড থেকে এসেছে। শুনেছে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে নাকি তার বড় ডিগ্রীও আছে। বয়স রাসেল বসের কাছাকাছিই হবে। দেখতেও যথেষ্ট সুন্দরী আর স্মার্ট।

অফিসে এমন গুঞ্জনও ছড়িয়েছে যে, রাসেল স্যার মেয়েটাকে বিয়ে করতে চলেছে। শাবানা কখনও আশা করেনা যে বস তাকে বিয়ে করবে। তবুও এই ব্যাপারটা শাবানাকে যে, কিছুটা হলেও আহত করেছে তা মানব মনের একটা রহস্যই বটে! তবে অন্তরের এই সূক্ষ্ণ ব্যাথা সে অন্তরেই চাপা দিয়ে রেখেছে।

ওর মনে হয়েছে বস মেয়েটাকে যেন অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিচ্ছে। প্রায়ই দুজন মিলে চেম্বারে গুজুরগুজুর আলাপ করে। শাবানাকে দেখলেই থেমে যায় বা কখনও কখনও তাকে পরে আসতে বলে। এমনকি তার সাথে পরামর্শ না করেই বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই ব্যাপারটা শাবানা কোনো ভাবেই মানতে পারছেনা। এর সবই তার আত্মসম্মানে আঘাত করছে। তাই কিছুদিন ধরে তার মনে হচ্ছে যে, সম্মান বজায় রেখে এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো।

এরমধ্যে সবচাইতে ভয়ংকর ব্যাপার হলো শাবানার মনে হচ্ছে যে, ওর ছোটো বোন শামীমার উপর বসের নজর পরেছে। বোনটা তার কাছে থেকে কলেজে পড়ছে। রাসেল বস দুদিন আকার ইঙ্গিতে শামীমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিয়েছে। সুতরাং এর পরে কোনো ভাবেই এখানে থাকা চলেনা। তাই চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে বসের কাছে ডেজিগনেশন লেটার দিয়ে দিলো। লেটারের সাথে কোম্পানীর দেয়া গাড়ির চাবিটাও বসের সামনে রেখে চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসলো।

আজকের এই দিনটা হলো তার জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর। কারণ রাসেল স্যার একবারও তাকে লেটার ফেরত নেয়ার জন্য অনুরোধ করেনি। শুধু তার মুখের দিকে নিস্পৃহ ভাবে চেয়ে ছিলো। কোম্পানীটা দাঁড় করাতে গিয়ে কিভাবেই না শোয়েবের কামনার আগুনে নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছে এসব মনে পড়তেই শাবানার বুকের ভিতর হু হু করে উঠলো। প্রতিষ্ঠানের জন্য সর্বোচ্চ সাক্রিফাইসের পুরষ্কার হলো উপেক্ষা। কষ্টে শাবানার বুকটা গুড়িয়ে গেলো। নিজের চেম্বারে ঢুকে সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।

আরও কিছুক্ষণ পর মনটাকে শক্ত করে শাবানা উঠে দাঁড়ালো। তারপর কাউকে কিছু না বলে মাথা উঁচু করে অফিস ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

################

শুকনা হাসি দিয়ে বস রাসেলকে ড্রইংরুমে অভ্যার্থনা জানালো শাবানা। সৌজন্য বিনিময় ছাড়া দুজনের মধ্যে তেমন কথাবার্তা হলো না। রাসেল বিয়ের কার্ড আর একটা বড়ো এনভেলাপ এগিয়ে দিলে শাবানা নিস্পৃহ আগ্রহে সেসব নিয়ে সোফার উপরে রেখে দিলো। রাসেল শাবানার ছোটবোন শামীমার সাথেও হালকা রসিকতা করলো। ওর হাতে একটা সুদৃশ্য প্যাকেট দিয়ে সবচাইতে আকর্ষণীয় পোশাক পরে বিয়েতে আসতে বললো। কারণ তাকে ছাড়া নাকি বিয়ের অনুষ্ঠান জমবেই না। চা খাওয়ার জন্য বললে আরও কয়েক জায়গায় কার্ড পৌঁছাতে হবে বলে রাসেল পর্বটা এড়িয়ে গিয়ে বিদায় নিলো।

বোনকে রেখে শাবানা বেডরুমে চলে এলো। এখনো অনেক গোছগাছ বাকি আছে। ৫/৬ দিনের মধ্যে সে বাসাটা ছেড়ে দিবে, অফিসকে সেভাবেই বলে রেখেছে। এসময় বোনের তীক্ষ্ণ চিৎকারে শাবানা দৌড়ে ড্রইং রুমে চলে এলো। ‘আপু, এটা দেখো। এসব কি? আমিতো কিছুই বুঝছি না!’ শাবানা দেখলো শামীমা ফ্যালফ্যাল করে বিয়ের কার্ডের দিকে চেয়ে আছে। সে কার্ডটা আপুর দিকে এগিয়ে দিলো।

বোনের মতো শাবানাও হতভম্বের মতো কার্ডের লেখাগুলোর দিকে চেয়ে আছে। সেখানে বিয়ের কনে হিসাবে সোনালী অক্ষরে ওর নাম জ্বলজ্বল করছে। গার্জেন হিসাবে ওর বাবা-মার নামও দেয়া আছে। শাবানার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। সে ফুঁপিয়ে উঠে ধুপ করে সোফায় বসে পড়লো।

বসের রেখে যাওয়া এনভেলপটা হাতে লাগতেই শাবানা ওটার মুখ একটানে ছিড়ে ভিতরের কাগজগুলো বের করলো। স্ট্যাম্পে লেখা কথাগুলি পড়তে পড়তে সারা শরীরে আবারও কাঁপুনি উঠে গেলো। রাসেল তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্থাবর অস্থাবর সকল সম্পত্তি, এমনকি এই বাসাটাও ওর নামে লিখে দিয়েছে। এখন থকে সবকিছুর মালিকানা তার। কি করবে ভেবে পাচ্ছনা শাবানা। গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সেটাও পারছেনা। ভিতরের সব কষ্ট আর আনন্দগুলি মিলেমিশে অশ্রুজলে রুপান্তরিত হয়ে গাল বেয়ে নেমে আসছে।

প্রচন্ড অভিমানে শাবানার মেজাজটাও গরম হয়ে গেছে। বলা নেই কওয়া নেই এমনকি ওর মতামতটাও নেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি! বিয়ে করবো বললেই হলো? পাগলটা এখন কোথায় আছে কে জানে? তাকে ধরতেই হবে। জামাকাপড় চেঞ্জ করার সময় নাই। কোনও রকমে একটা স্যান্ডেল পরেই শাবানা দরজার দিকে দৌড় দিলো। তারপর পাল্লা খুলে সামনে পা বাড়িয়েই হুড়মুড় করে পড়ে গলো। রাসেল এতোক্ষণ দরজার ওপারে চুপচাপ মেঝেতে বসেছিলো। শাবানা তাকে নিয়েই গড়িয়ে পড়েছে।

শাবানা প্রাইভেট হাসপাতালের বেডে শুয়ে রহস্যময়ী চাঁদনীর দেখো পেলো। সে আসলে রাসেলের খালা। তবে সমবয়সী হবার কারণে সম্পর্কটা ছোটবেলা থেকেই বন্ধুর মতো। রাসেলের কাছে সব শুনার পর দুজনের বিয়েটা দেয়ার জন্যই নিউজিল্যান্ড থেকে ছুটে এসেছে। খালা তাকে হাসপাতালের বেডে এই বলে শাসিয়েছে যে, শাবানা যেনো কখনো রাসেলকে ছেড়ে না যায়। কারণ তাকে ছাড়া রাসেল চলতেই পারবে না।

বিয়ের দিন অদভুত একটা দৃশ্য দেখা গেলো। শাবানার কপালে তখনও স্টিচ লাগানো। কনের কপালে ওটাকে এখন চাঁদের কলঙ্কের মতোই দেখাচ্ছে। রাসেলকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ার সময় চৌকাঠে লেগে কপালটা কেটে গিয়েছিল। বিয়েতে দুজনের জীবনের সব কলঙ্ক মুছে গেলেও শাবানার কপালের কাটা দাগটা এখন চাঁদের কলঙ্কের মতোই সৌন্দর্য বিতরণ করছে। (শেষ)