জুলাই ১৯৮৪
“ঢাকা শহরের রঙ কী?”—এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া কঠিন। তবে টানা সাতদিনের বৃষ্টির পর, শহরটা যেন ধুয়ে গিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। রাস্তায় পানি, দেয়ালে স্যাঁতসেঁতে দাগ, ছাউনির নিচে জবুথবু মানুষ—সব মিলিয়ে একটা ভারী ক্লান্তি ঝুলে আছে বাতাসে। এই ক্লান্ত শহরের ভেতরই মাথা তুলেছে কিছু লাল-সাদা আড়াইতলা নতুন ভবন। ঠিকমতো দেখা যায় না সেগুলো—না রঙ, না ভেতরে থাকা লোকজনের মুখ। যেন ঢাকার ভবনগুলোর মতোই তাদের বাসিন্দারাও আধো-আলো আধো-অন্ধকারে বাস করে।
দেশে অল্প কিছুদিন হলো সেনাশাসন জারি হয়েছে। এ দেশে মানুষ আর মতামতের কোন অভাব নেই। তাই দেয়ালে পোস্টার, কলামে বিবৃতি—সব আছে, কিন্তু চায়ের দোকানে কেউ এবার আগের মতো জোরে কথা বলছে না। খবর শোনার সময় রেডিওর ভলিউম থাকছে মিনিমামে। ক্ষমতা দখলে একটা গুলিও ছোড়েনি সেনাশাসক। কিন্তু তারপরেও যেন শহরটা নিজেই শ্বাস আটকে আছে—শুধু বৃষ্টির শব্দেই কিছু খোলামেলা।
এই শহরেরই এক কোণায়, গ্রীণরোডের এক মেসে, টিনচালার নিচে থাকে শফিক। বয়স একুশ। তিতুমীর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ে, অন্তত বলার সময় তাই বলে। কিন্তু আসলে সে কী করে বা করতে যাচ্ছে—এটা তার মনেই একটা বিশাল প্রশ্নবোধক। সেই প্রশ্নবোধকটা আজকাল ক্লাসরুমের চেয়ে শহরের রাস্তায় বেশি ঘোরায় তাকে। ঢাকা এসে বাউন্ডুলে হয়ে যাওয়া এরকম তরুণ অবশ্য সংখ্যায় কম নয়। সবার প্রায় একই মধ্যবিত্ত সমস্যা। যেমন- শফিকের বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে—রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের হিসাব বিভাগে।
আজীবন টাকার হিসাব কষে গেছেন, কিন্তু নিজের পকেট কখনো খুব ভরেনি। ঘুষ খেতে দেখেছেন, সেটার ভাগ বাটোয়ারা কাগজে কলমে মিলিয়ে ছোটখাটো বখরা জুটেছে। কিন্তু বড় দাও মারার জায়গায় তিনি পৌছাতেই পারেন নি। না পদে না সাহসে। তাই রিটায়ার করে সাভারে আধাপাকা বাড়ি, একটা ফ্রিজ আর টেলিফোন লাইন নিয়ে শান্তিতে বসবাসটাই এখন তার জীবনের অর্জন। ছেলের জন্য তার ইচ্ছাও পরিষ্কার—সরকারি চাকরি, কাস্টমস বা পুলিশ। যেন বখরাবঞ্চিত জীবনটা তার না হয় একেবারেই। শফিক মুখ ফুটে কখনো না বলেনি, কিন্তু এখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বই খুললেই তার মনে হয়—এইসব জেনে অফিসার কীভাবে হবে? আর অফিসার হলে এইসব জেনেই বা কী হবে? অন্য কেউ হলে হয়তো প্রতিবাদ করত, নয়তো করতো একাডেমিক পরিশ্রম। শফিক হাঁটতে শুরু করেছে।
কলেজের শুকনো ক্লাস আর হাজিরার হিসাবের ঘোর কাটিয়ে শফিক আজকাল ঢাকার রাস্তায় হাঁটে। কখনো কার্জন হল, কখনো মতিঝিল, আবার কোনো দিন পৌঁছে যায় বুড়িগঙ্গার ঘাটে। শহরটা যেন এখন তার ক্লাসরুম—চুপচাপ, বৃষ্টিভেজা, কিন্তু জেগে থাকা।
আজ হঠাৎ হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ল বাংলা মটরে কাজ করা তার ফুপাতো ভাই মাকসুদের কথা। আগেও একবার এসেছিল, তবে অনেকদিন হয়ে গেছে। মাকসুদদের দিন একসময় কেটেছে টানাটানিতে, এখন গায়ে-পরা জামাকাপড়, ফোনে কথা বলার ভঙ্গি—সবই পাল্টে গেছে। কীভাবে বদল হলো, তা নিয়ে কেউ জিজ্ঞেস করে না। মাকসুদও বলে না। “চলেই যাই না কেন?”—ভাবল শফিক। বৃষ্টি থেমে এসেছে খানিকটা, রাস্তায় কাদা আর মানুষের ধৈর্য একসাথে শুকোচ্ছে। বাংলা মটরের গলির মধ্যে একটা পুরনো তিনতলা ভবনের নিচতলায় মাকসুদের অফিস। ভেতরে ঢুকতেই গন্ধ—কালির, গরম মেশিনের, ভেজা কাগজের। কোণার একটা ডেস্কে বসে মাকসুদ, চায়ের কাপ হাতে। তার মুঝে সব সময় ঝোলানো একটা তেলতেলে হাসি।
গল্প জমতে দেরি হলো না। কাজের ফাঁকে চা খেতে খেতে জানাল, ওরা “সানরাইজ” নামে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং সেন্টারের লিফলেট ছাপে। অন্তত, বাইরের দুনিয়ায় সেটাই তাদের পরিচয়। কিন্তু শফিক আগেও লক্ষ করেছে আজও করল—মাকসুদের চলাফেরা, কথা বলার ভঙ্গি, চোখেমুখে সেই সাধারণ প্রেসের লোকের ভাব নেই। যেন সে কালি গোলা লিফলেট নয়, অন্য কিছু ছাপে। হয়তো টাকাই ছাপে। কে জানে?
“হ্যাঁ হ্যাঁ, এতেই চলবে।”
দৃঢ় একটা গলায় ছেঁড়া সুতোয় টান পড়ল—শফিকের ভাবনায় থেমে গেল শব্দ। গলার মালিককে দেখে মনে হলো, সে এই প্রেসে মাকসুদের চেয়েও যেমন বেমানান, তেমনি এখানে আসাটাও মাকসুদের চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়। লোকটার জুতো চকচক করছে। বাদামি কোটের নিচে ধবধবে পাঞ্জাবি, জামার ভাঁজে ভাঁজে আয়েশি আতর। কথায় মাপে কিপটে, কিন্তু চালচলনে স্পষ্ট ওজন। একটা পাতলা ফিচকে হাসি ঠোঁটে ধরে লোকটা মাকসুদকে বলল, “কিন্তু শোনেন মাকসুদ মিয়া, আমার তো একজন মানুষ লাগবে। বিলি-বিতরণের জন্য। আগের টাউট-বাটপারগুলা দিয়ে হইবে না। নতুন কাউরে লাগবে—একদম পরিষ্কার ছাঁদ-ছোড়া ছেলে।”
মাকসুদের তেলচিটে হাসি বিন্দুমাত্র না নড়ে সে উত্তর দিল, “আছে তো! এই যে আমার ভাইটা বসে আছে। তিতুমীরে পড়ে, খুব ভালো ছেলে। ওর রেকর্ড? একদম ধানমন্ডি লেকের পানির মতো—চোখ রাখলেও তলা দেখা যায়।”
লোকটা এবার শফিকের দিকে ফিরল। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ তাকিয়ে থেকে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, “বাড়ি কই?” “সাভারে,” মাকসুদ উত্তর দিলো সঙ্গে সঙ্গেই, “বাবা রোডস অ্যান্ড হাইওয়েতে চাকরি করতেন।” লোকটা এবার সরাসরি শফিকের চোখে চোখ রাখল। তার কণ্ঠ গভীর হয়ে গেল, “ভয় পাইলে আগে কার নাম মুখে আসে—আল্লাহ, না আম্মা?”
প্রশ্নটা এমন অপ্রস্তুত করে দিল শফিককে যে কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে শুধু বলল, “মানে… আমি ঠিক…”
লোকটা নিজেই বাক্য শেষ করে দিল, “মানে, সাবধান থাকতে হবে এই লাইনে। কাজ সোজা না। কিন্তু টাকা-পয়সা? ভালোই দিব।” শফিক মাথা নাড়ল—না বুঝে, না না-জেনে। যেন গলা দিয়ে কিছু বের হওয়ার আগেই তার জবাব কেউ দিয়ে দিয়েছে।
লোকটা এবার চেয়ার সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। কথা শেষ করার ভঙ্গিতে বলল, “রুম ২০৯। শনিবার। হোটেল পূর্বানী। বিকেলে চলে আসবা। একা। কিছু আনতে হবে না।” একটা ঝটকায় দরজার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল লোকটা। দরজা আবার ধীরে ধীরে বন্ধ হলো। প্রেসে বৃষ্টির শব্দ ঢুকল জানালার ফাঁক দিয়ে—আবার।
—–
হোটেল পূর্বানীর করিডোরটা যেন ধোঁয়ার ভেতর ডুবে থাকা পুরনো সময়—নামঘর থেকে লাইন ধরে সাজানো ঘর, ফিকে আলো, কার্পেটের নিচে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। রুম ২০৯-এর সামনে এসে শফিক থামল। দরজায় হাত তোলার আগেই সেটা খুলে গেল। এবার অবশ্য অবাক নয় হতবাক হবার পালা।
সামনে কোন বাদামী কোটি সাদা পাঞ্জাবীর লোক নেই। যে দাঁড়িয়ে আছে সে একজন নারী। বেশ সুন্দরী একজন নারী। খালি পা, ক্রিম রঙের একটা শাড়ি বুকে কেমন আলগা ভঙ্গিতে আঁটা, ভেজা চুল ঘাড় ছুঁয়ে আছে। চোখে মোটা কাজলের দাগ, ঠোঁটে কোনো অভিব্যক্তি নেই। কণ্ঠে না আমন্ত্রণ, না বিরক্তি।
“তুমি কি শফিক?” তার গলা শুষ্ক।
“জ্বি,” বলল শফিক।
সে সরে দাঁড়াল। “ঠিক সময়ে এসেছো। গুড। আমি সময়ে দেখা দেয়া পছন্দ করি। এসো, ভেতরে এসো।”
ঘরে ঢুকে শফিক প্রথমে টের পেল বাতাসের ভিন্নতা—চন্দনের গন্ধ, সাথে একটা মাদকা শরীরী ঘাম মিশে থাকা স্নায়বিক উত্তেজনা। টিভি চলছে মিউটে। ফাইল রাখা বিছানায়, পাশে একটা কনডমের প্যাকেট।
“তোমাকে একটু পরীক্ষা দিতে বলা হয়েছে,” সে বলল।
শফিক কাঁধ শক্ত করে জিজ্ঞেস করল, “আমি বুঝিনি ঠিক…”
“এই লাইনে কেউ বুঝে আসে না,” তার গলা ঠাণ্ডা, “তাদের তৈরি করতে হয়। তোমাকে দেখেই বোঝা যায়, তৈরি হয়ে যাবে।”
সে ধীরে বিছানার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল, নিজের গায়ে হাত বুলিয়ে শাড়ির আঁচল সামনের দিকে টেনে আনল, তারপর ছুঁড়ে ফেলল। মেয়েটার শাড়িটা পাতলা ছিল না বলে বোঝা যায় নি কিছুই। কিন্তু ব্লাউজটা বেশ বিপদজনকভাবে লো কাট। পরিষ্কার যা দেখা যাচ্ছে তা হল তার স্তনদুটি ভারী, গভীর। স্তনবৃন্তগুলো টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন আগেই জেনে বসে আছে পরবর্তী মিনিটগুলোয় কী ঘটতে চলেছে। তার ত্বক, তার দৃষ্টি, তার ভঙ্গি—সব কিছু ছিল দাবি করে নেওয়ার মতো।
শফিকের ভেতরে তখন গুঞ্জন চলছিল—ভয়, লোভ, তৃষ্ণা। কিন্তু পা পেছানো আর সম্ভব ছিল না।সে জামা খুলল—ধীরে, কিন্তু নিঃসংকোচে। তারপর এগিয়ে এল।
প্রথম স্পর্শটা হয়েছিল বুকের ওপর—হাত রাখল সে, ওর ঠোঁট ছুঁয়ে গেল শফিকের গলায়। মুহূর্তেই ওর শরীর যেন বদলে গেল, নরম থেকে শক্ত, স্তিমিত থেকে দাবানল। তাবু হয়ে আছে নিউমার্কেট থেকে কেনা প্যান্টের সামনের দিকটা।
নারীটিকে বিছানায় ঠেলে দিল সে। ওর পায়ের ফাঁক দিয়ে হাত বোলাতে বোলাতে চুমু দিল বুকজোড়া বরাবর—প্রথমে বাম, তারপর ডান, তারপরে নিচে নেমে গেল নাভির ঠিক গা ঘেঁষে। হালকা মেদ আছে পেটের ওপর। শখ করে চুমু দিতেই নারী শরীর বাঁকিয়ে কেঁদে উঠল, কাঁধে নখ বসিয়ে ধরল তাকে।
শফিক নিজের প্যান্ট নামিয়ে ওর শরীরের ওপর উঠে গেল। তারপর এক হালকা ঠেলায় ঢুকে পড়ল দেহের ভেতরে—নতুন, স্যাঁতসেঁতে, গরম এক গুহার ভিতর। ওর মুখ দিয়ে এক অর্ধভাঙা শব্দ বেরিয়ে এল। সে শুরুর দিকে ধীরে ঠেলছিল—একটা ছন্দ ধরে। কিন্তু তারপর, সে বুঝল—এ নারী শুধু নিচ্ছে না, ফেরতও দিচ্ছে।
রীতিমত কোমর তুলে শফিকের তালে তালে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে। ওর চোখ অর্ধেক বন্ধ, মুখে অশ্লীল সুখের ছায়া। এবার সে ওকে উল্টে দিল, পেছন থেকে ওর পাছা চেপে ধরে আবার ঢুকল। এবার অনেক গভীর, অনেক বেশি তাড়িত। প্রতি ঢুকে সঙ্গে সঙ্গে একটানা শব্দ ওর গলা থেকে বেরোচ্ছে।
সে ওর চুল মুঠো করে ধরে আরও এক ঠেলা দিল, তারপর দু’হাতে কোমর চেপে একনাগাড়ে ঢুকতে লাগল। ওর নখ বিছানায় আঁচড় কাটছিল, ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল ঘাম, চামড়া আর কাঁচা কামনার গন্ধে। “এই… এইভাবে, আরো আরো… ছাড়িস না, আহ” নারী ফিসফিস করছিল—নিয়ন্ত্রণে থেকেও যেন নিজেই নিয়ন্ত্রিত। ওর শরীর বারবার কেঁপে উঠছিল, যোনি গড়িয়ে উঠছিল আরও ভিজে, আরও গভীর।
শেষ ধাপে শফিক ওকে পুরো গলায় টেনে ধরল, গায়ে ভার দিয়ে শেষ কয়েকটা ঠেলা দিল একেবারে গোঁড়া পর্যন্ত। ঢেলে দিল যা জমে ছিল ভেতরে। তারপর একসাথে ওদের শরীর থেমে গেল—তবু ঘরে এখনও ওদের ধাক্কাগুলোর প্রতিধ্বনি রয়ে গেছে।
ও চুপচাপ পড়ে রইল। তারপর সিগারেট ধরাল। ধোঁয়ার ঘূর্ণি ছুঁয়ে উঠল ছাদ।
“চেহারায় যতটা নিষ্পাপ, আসলে ততটাও অপদার্থ নও” নারী বলল একটা বাকা হাসি সহ।
শফিক কথা বলল না। জামা পরে নিল। নারী ফাইলটা এগিয়ে দিল।
“সোমবার সকালে নিয়ে যাবে সেগুনবাগিচা। রুম ৩০১। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে, বিয়ের কার্ড দিয়ে যাচ্ছ।”
শফিক মাথা নাড়ল। দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল। পেছন থেকে কোনো বিদায় এল না। হোটেল পূর্বানীর করিডোরে ফিরে এসে সে থমকাল। শরীর ঘামে ভেজা, মনে এক অদ্ভুত ভার। কাজের আগেই যদি পুরষ্কার দেয়ার বিধান থাকে, কাজটাকে কেন যেন বলির বকরী হওয়া মনে হতে থাকে। ঠিক এরকম অস্বস্তিও রইল মন জুড়ে।
একটু পর বৃষ্টি শুরু হলো—নতুন করে, এবার আরও ধীরে। (চলবে)