উত্তর আমেরিকায় পড়তে আসা বাংলাদেশিদের জীবন চারটা কাজ দিয়েই খুব সহজে ম্যাপ করা যায়। প্রথমত, ডিগ্রির গর্বে মিনিমাম ওয়েজের কাছাকাছি বেতনে খাটতে খাটতে ৫–৭ বছরের বিদ্যাশিক্ষাকে ‘ভবিষ্যতের বিনিয়োগ’ বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়া। দ্বিতীয়ত, সেই গরীবি জীবন নিয়ে একে অপরের বাসায় গিয়ে পালা করে অভিযোগের দাওয়াতে অংশ নেওয়া। তৃতীয়ত, মাস শেষে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দেখে কে কতটা নিঃশেষ—তার টেনশনে ঘেমে-নেয়ে একাকার হওয়া। আর শেষত, সেমিস্টার শেষে এই তিন নম্বরী পাপচক্র থেকে ‘বাঁচতে’ একটা চকচকে রেন্টাল গাড়ি ভাড়া করে পাহাড়-প্রকৃতির দিকে ছুটে যাওয়া—যেন রোডট্রিপেই জীবন ঠিক হয়ে যাবে!
২০১৫ সালের সামারের এই গল্পটাও সেই ক্লাসিক রোডট্রিপ ফর্মুলাতেই শুরু। সাজিদ নামে এক ভাই ইউটাহর মোয়াব নামের একটা জায়গার ছবি দেখে এমন ধাক্কা খেয়েছে, মনে হলো সেখানে না গেলে তার পরের সেমিস্টারের ফান্ডটাই বুঝি অনিশ্চিত। ব্যস, রাফি নামে আরেকজনকে ধরে রাজি করিয়ে ফেলেছে—সামারের প্ল্যান: রোডট্রিপ টু মোয়াব। রাফি গেলে তার বউ মাইশাও যাবে—এই তো অলিখিত নিয়ম। এই আইডিয়া একবার ছড়াতেই সবাই লাফিয়ে পড়েছে—দশ-বারো জন যেতে চায়। কিন্তু যখন আসলেই বেরোনোর সময় এল, তখন দেখা গেল এই উৎসাহী গ্রুপ থেকে ফিল্টার হয়ে টিকে আছে কেবল তানভীর নামে আগের সেমিস্টারেই নতুন আসা এক ছেলে। বাকিরা দাওয়াতি পোলাওয়ের পর পাওয়া সেই আলগা এনার্জি নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপচ্যাটে যাব-যাব করে শেষমেশ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এদিকে মাইশা একা একা একমাত্র মেয়ে হয়ে রোডট্রিপে যেতে একদমই রাজি না—“দেখতে কেমন লাগে!”—এই নিয়ে অনেক ঘ্যানঘ্যানের পর শেষমেশ সে তার ডিপার্টমেন্ট থেকে টেনে আনল এক “ভদ্র-মেয়েলি” সহপাঠীকে—নাজিয়া, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সে মাস্টার্স করছে। চুপচাপ, লাজুক, “ভালো মেয়ে” টাইপ।
রাফির ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল, ধৈর্যও ছিল—শাওলিন টেম্পলের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মতো। কিন্তু টানা ২০০০ মাইলের ড্রাইভিং শুনে সেও একটু থতমত খেয়ে গিয়েছে। তানভীর আর নাজিয়া তখনও এক বছরেরও কম সময় হলো আমেরিকায় এসেছে—তাদের কেউই এখনো ড্রাইভ করে না। সাজিদ পাঁচ মাস আগে লাইসেন্সের জন্য এপ্লাই করে একবারও স্টিয়ারিং না ধরে মোয়াবের ছবি দেখে জীবনের লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য ঠিক করেছে। আর মাইশা গাড়ি চালাতে পারলেও পাশের ওয়ালমার্টেও জামাই না চালালে যায় না—সেই হিসেবে সেও একেবারেই স্টিয়ারিংয়ের বাইরে।
তখনই ওরা আমার কথা ভাবল। বা বলা ভালো, ভাবতে বাধ্য হলো।
আমি ওদের মূল সার্কেলের কেউ না। শুক্রবারে ক্যাম্পাসের সেই জীর্ণ মসজিদে নামাজ পড়তে যাই না, দেশি গেম নাইটে লুডু খেলতে মন টানে না, আর “সাপ্তাহিক গরু সাবার কর্মসূচি”—মানে ওই সবাই মিলে রান্না করে খাওয়ার দাওয়াতেও এক-দুইবারের বেশি যাইনি। গেলেও ক্যাবলা হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, তারপর চুপচাপ বাসায় চলে আসি। প্যাসিভ-অ্যাগ্রেসিভ রাজনৈতিক চেচামেচি, ধর্ম নিয়ে লাফালাফি, আর কমিউনিটির ক্যাচাল—আমি এসব থেকে যতটা পারি দূরে থাকি।
কিন্তু আমি গাড়ি চালাতে পারি। পারি বলাটা কম হয়ে যায়। বাস্টার্ডের মতো চালাই—ফাস্ট, ক্লিন, ফোকাসড।
আর সামারে এই হ্যাটিসবার্গ নামের এই কলেজটাউনে এমনিই এমন ম্যান্দামারা দশা—বাইরে যেন “কোথাও কেউ নেই” নাটকের সেট, ঘরের ভেতরে ছাইরঙা কার্পেটের পশম গোনাও শেষ—এই অবস্থায় বেডরুমে বসে পচে মরার চেয়ে ২০০০ মাইল ড্রাইভ করে ইউটাহর মরুভূমিতে পাহাড় দেখতে যাওয়াটা তখন আমার কাছে খুব একটা খারাপ অপশন মনে হয়নি।
এই গ্রুপে প্রায় সবার সাথেই একবার না একবার কথা হয়েছে। অবশ্যই রাফির বাসায় দাওয়াতে। ওই যে, উপায় না দেখে এক-দুইবার গেছি, যেদিন একা ঘরে বসে থাকাটা আর সহ্য হচ্ছিল না।।
একজন বাদে—নাজিয়া।
কোনো দাওয়াতেই তাকে একটা “হাই” পর্যন্ত বলা হয়নি। ক্যাম্পাসে দূর থেকে দেখলেও পথ মেলেনি একবারও। তবে বছরখানেক ধরে সে যে এখানে আছে, সেটা চোখে পড়েছে ওই ভাসাভাসা উপস্থিতি নিয়েই। মেয়েটা দেখতে ভালোই—গায়ের রং হালকা, দেখতেও শুকনো পাতলা ধাচেরই, চোখ দুটো ঠান্ডা, কথা কমই বলে। আমার মতো বাউন্ডুলে ব্যাচেলরের সাথে কথা বলার কোটা তার না থাকাটাই স্বাভাবিক।
তবে একটা ছোট ব্যাপার ছিল এর মধ্যে।
নাজিয়ার একটা লুকানো ইনস্টাগ্রাম একাউন্ট ছিল। যার লিংক কোথাও নেই, কেউ ট্যাগ করে না, আর নামের বানানটা এমনভাবে ঘুরিয়ে রাখা—যেন খুঁজতে গেলে না পাওয়া যায়। কটু আধটু নষ্টামি করতে মন চায় টাইপের একাউন্ট। চিরাচরিত বাঙালি তরুণী সমস্যা—নিজেকে একটু অন্যরকমভাবে দেখতে চায়, কিন্তু সমাজের চোখে না পড়েই। সেই অ্যাকাউন্টটা তাই একরকম মুক্তির খাঁচা—যেটা আবার ফেসবুকের চাচা-মামারা দেখে ফেললে সামাজিক-ক্যারিয়ারের বারোটা।
আমি অবশ্য কীভাবে কীভাবে যেন সেই প্রাইভেট একাউন্টে নজরদারির লাইসেন্স পেয়ে বসে আছি একটা রিকুয়েস্ট দিয়েই। সেই একাউন্টের কিছু ছবি আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল।
একটাতে নাজিয়া দাঁড়িয়ে আছে রেস্টরুমের আয়নার সামনে। সাদা ট্যাংকটপ, নিচে নীল কাউগার্ল কাটের লো-রাইজ জিনস। কোমরের হাড় দুপাশে স্পষ্ট, নাভির নিচে হালকা শ্যাডো। ট্যাংকটপটা গলার কাছে হালকা ভেজা, বুকের বাঁদিকের স্ট্র্যাপটা সরে গেছে—ভেতরের কালো ব্রালেট দেখা যাচ্ছে। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, সবে ধোয়া চুল ভেজা হয়ে গলায় গড়িয়ে পড়ছে। ক্যাপশন দেয়া: “Didn’t plan to post this.”
দ্বিতীয়টা ছিল ঘরে, সম্ভবত দুপুরে। মেয়েটা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে—স্কিনটাইট শর্টস আর ঢিলেঢালা অফ-শোল্ডার গ্রে টপ পরে। দুপাশের কাঁধ নেমে ক্লিভেজের বেশ খানিকটা সূর্যের আলো গিলে ফেলার মত উন্মুক্ত করে দিয়েছে। পায়ের আঙুলে গাঢ় লাল নেইলপলিশ, মোবাইল হাতে, নিজের পায়ের দিকেই তাকিয়ে। ছবি দেখে বুঝে নিতে কষ্ট হয় না—সে জানে, তার শরীর কেমন করে ক্যামেরায় ধরা পড়ে।
তবে সবচেয়ে দাগ কেটেছিল তৃতীয়টা—বৈশাখ টাইপ কোনো ইভেন্টের দিন তোলা। ছবিটায় সে পরেছিল কালো শিফনের শাড়ি, আরো কালো স্লিভলেস ব্লাউজ, কোমরের একপাশে আঁচল খসে পড়া। শরীরটাকে শক্ত করে ধরে রাখার কোনো চেষ্টাই করেনি। পেটের নিচে একটা পাতলা সিলভার চেইন ঝুলছিল, নাভির ঠিক নিচে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, পেছনের কাঁধ, ঘাড় আর পিঠ খোলা। চোখে একধরনের অবজ্ঞা—কে দেখছে তাতে তার কিছু আসে যায় না, কিন্তু সে জানে সে দেখা যাচ্ছে। আমি হলফ করে বলতে পারি ইভেন্টে মেয়েটাকে দেখেছিলাম। একই শাড়ি পরে এসেছিল—আচলটা গলা জড়িয়ে, ব্লাউজের ওপর দিয়ে টেনে গুছিয়ে রাখা। শাড়ি-চেহারা এক রেখে শুধু মেয়েটা বদলে গিয়েছিল।
যাই হোক আমি এই তিনটে ছবিতে রিয়াক্ট ও করেছিলাম। সে আমাকে ফলো ব্যাক করেনি। কিন্তু অ্যাকাউন্টটা ডিলিট করেনি, আমাকে রিমুভও করেনি।
ট্রিপের শুরুতে অবশ্য আমাকে চেনে সে—এইরকম কোনো ইশারা দিল না। এবারও “হাই” বলা হলো না। আমিও খুব খেয়াল করলাম না ব্যাপারটা। আসলে শুরুটা সব মিলিয়ে খারাপ হয়নি ট্রিপের, তাই মনোযোগ সরল না ওর দিকে। সবাই প্রায় টাইমেই চলে এসেছে, আর মাইশার অতি ডিটেইল্ড প্ল্যানটাও অদ্ভুতভাবে ঠিকঠাক কাজ করছে—এইটাও বোধহয় বিশাল বিস্ময়ের নাম। তবে বাঙালি গ্রুপে গন্ডগোল ছাড়া রোডট্রিপ শুরু হবে—এটাই আশা করা বাড়াবাড়ি। ইন্টারস্টেটে ওঠার মুখে তানভীর মুখটা এমন করল যেন জাতিসংঘে রেজ্যুলুশন আনছে: “আমি শুধু হালাল খাই।” মাইশা একটু হাসি দিয়ে বলল, “আরে সমস্যা কী! অনেকেই তো করে সেটা। ফিশ বা সিফুড অপশন থাকবে যেখানেই থামব।” তানভীর গলা নামিয়ে বলল, “মাছও খাই না। গন্ধ লাগে।” ভ্যানে মুহূর্তের জন্য হালকা একটা “ইয়ে…” টাইপের নীরবতা ভেসে রইল। সাজিদ তখন সার্কাস মাস্তানদের ভঙ্গিতে বলল, “চলো, আগে একটা ফ্রাই খেয়ে নেই, পরে নাক-কান-গলা ডিপার্টমেন্ট দেখা যাবে।” একটা ড্রাইভ-থ্রু থেকে সবাই নিজের মতো কিছু না কিছু অর্ডার করল—ফ্রাই, নাগেটস, বার্গার- সাথে ডায়েট কোক, নিজের সম্মান বাঁচানোর অল্প চেষ্টায়।
এই পর্যায়ে মাইশা নিচু গলায় রাফিকে সাবধান করে দিল, “এক্সট্রা চিজ নিও না কিন্তু তুমি। হজম করতে পারনা কোনদিনই।” রাফি মাথা ঝাঁকিয়ে গাড়ি আগাল, আর স্পীকারে গিয়ে গম্ভীরভাবে বলল, “এক্সট্রা চিজ, ডাবল।” মাইশা তাকিয়ে রইল। কেউ কিছু বলল না। রোডট্রিপের প্রথম দিনে মানুষজন সবকিছুই ‘মজা’ হিসেবে হজম করতে চায়। আমি হাসিতে যোগ দিলাম না—শুধু একটু চোখের কোণে ভাঁজ পড়ল।
এরপর থেকে গাড়ি নিজের ছন্দে চলতে লাগল। কেউ জানালার দিকে হেলে, কেউ গানের প্লে-লিস্ট ঘাঁটছে, কেউ চিপসের প্যাকেটে মুখ গুঁজে বসে আছে—সবাই যে যার মতো করে রোডট্রিপের সঙ্গে বোঝাপড়ায় নেমে পড়েছে। নাজিয়া বসেছিল পেছনের ডান কোণায়—রাফি চালাচ্ছে, তার পাশে মাইশা, তাই ওর সেই সিটটা একরকম বরাদ্দ হয়ে গেছে। কিন্তু পেছনে ডানের সিটটা ফাঁকা থাকায় ভ্যানে মাঝে মাঝে হালকা ঝাঁকুনি লাগছিল। রাফি হেসে বলল, “পেছনে একটা সিট খালি থাকলে গাড়ি একটু বাউন্স করে। পেছনে যে বসলা নাজিয়া, উড়ে যেওনা কোন ঝাকিতে আবার। দেখো!” নাজিয়া জানালা থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, “আমি ঠিক আছি, ভাইয়া।”
কিন্তু বিশ মিনিটও পেরোয়নি, আমি বুঝলাম রাফিই ঠিক নেই। স্টিয়ারিংয়ে শ্লথতা, লেন চেঞ্জে অদ্ভুত দেরি, আর ব্রেক করলে গাড়িটা যেন হেঁচকি খাচ্ছে। রিয়ারভিউ মিররে চোখ পড়তেই দেখি—কপাল ভিজে গেছে, ঠোঁট ফ্যাকাসে, চোখ দুটো অবসন্ন। লোকটা যেন শরীরের প্রতিটি কোষ দিয়ে লড়ছে—কিন্তু কোনো যুদ্ধই জেতা সম্ভব হচ্ছে না।
“রাফি… সাইড করা দরকার মনে হয় তোমার,” আমি শান্ত গলায় বললাম।
সে মুখে কিছু না বলেই গ্যাস স্টেশনের দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। থামামাত্র দরজা খুলে এক দৌড়ে রেস্টরুমের দিকে—দুই হাতে পেট চেপে, মাথা ঝাঁকিয়ে যেন ভিতরে কেউ ড্রাম বাজাচ্ছে।
“আবার সেই চীজ, তাইনা?” – মাইশা একচোট গাল দিয়ে পেছনে ছুটল।
বাকিরা একে একে গাড়ি থেকে নামল। কেউ ঠাণ্ডা পানি কিনতে, কেউ বেঞ্চে বসে পড়ল, কেউ সিগারেট ধরাল। আমি পেছনে হেলান দিয়ে বসে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই চিবুচ্ছিলাম—চিজে লেপা, ঠিক যেটার কারণেই এই বিপত্তি। সাজিদ হালকা গম্ভীর স্বরে বলল, “এই অবস্থায় সামনে না যাওয়া মানে ট্যুর এখানেই শেষ। আবার রাফি ভাইরে ফেলে রেখেও তো যাওয়া যায় না। উনি এখন একদম ডাউন।”
এই সময় মাইশা ফিরে এল। চোখ লাল, কণ্ঠে বিরক্তি, গলার নিচে মোবাইল ঠেসে রেখেছে। “ডাক্তার দেখাতে হবে। একটা ক্লিনিক বের করছি, ইনস্যুরেন্সে পড়ে। আমি যাচ্ছি ওকে নিয়ে। তোমরা কেউ যেতে চাও, যাও। তবে রাফির জন্য এই মোয়াব রোডট্রিপ একদম বাদ।”
তানভীর তখন গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “আমার কাল থিসিস রিভিউ সাবমিশন আছে…ইউটাহর পাহাড়ের ভেতরে নেটওয়ার্ক না থাকলে ঝামেলা। আর তাছাড়া তিনটা ছেলে, একটা মেয়ে নিয়ে মরুভূমির দিকে যাওয়া—বাসায় কাউকে কিছু বলিও নাই। আম্মু জানলে একটা কোর্ট কাচারি বসাবে ফোনেই। আমিও না যাই।”
আমি কিছু বললাম না। আবারো ঠান্ডা মাথায় চিজি ফ্রাইয়ের একটা টুকরো মুখে দিলাম।
ঠিক তখনই, গ্যাস স্টেশনের পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল মেয়েটা।
তাকে দেখে প্রথমেই যে শব্দটা মাথায় আসে সেটা হল—ধুলো। সূর্যের ঝলসানি আর ধূলো মিশে তার গায়ের চামড়ায় পড়েছে বাদামি সোনার মতো আলো। সেটা গায়ের রঙ নাকি আলো বোঝা বেশ কঠিন। পরনে পুরোনো ছেঁড়া ডেনিম শর্টস—উরুতে আঁটে আবার হাঁটার সাথে সাথে আলগা হয়, নিচে তেলচিটচিটে হাইকাট বাদামী বুট। চুলগুলোর সাথে বুটটা মনে হয় ইচ্ছা করেই ম্যাচ করে উপরে ধূসর কাউবয় শার্ট, কোমরের কিছুটা ওপরে গিট দিয়ে বাধা। সামনের দিকটা যেন হাওয়ায় হালকা উঠছে—বুকের ভাঁজে জমে থাকা ছায়া চোখে পড়ে যায় বারবার। পিঠে ঝুলছে লাল রুকস্যাক, কানে হেডফোন গোঁজা, ঠোঁটে ধরা অর্ধেক জ্বলা সিগারেট। চুলগুলো এমনভাবে এলোমেলো যে মনে হয়, কেবলই পাহাড়ে ঘুরে নেমে এসেছে, অথচ তাতে কোনও অবসাদ নেই—একধরনের অভ্যস্ত ক্লান্তি আছে যা এই রকম ভবঘুরে মেয়েদেরই থাকে। তার চোখে ছিল আত্মবিশ্বাসের স্থিরতা, ঠোঁটে বিরক্তির নয়, কৌতূহলের রেখা।
সে এগিয়ে এসে বলল, “তোমাদের দেখে stuck মনে হচ্ছে।”
আমি হাসলাম, “চিজ অ্যাটাক। ট্রিপ অচল। এখন মহাকালের শেষ দেখা পর্যন্ত এই বেঞ্চেই কাটিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছি।”
মেয়েটা সিগারেটটা আঙুলে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, “মোয়াবের কথা শুনলাম মনে হল। আমিও যাচ্ছি ওদিকেই। রেন্টালটা সামনে সার্ভিস লেনে রেখেছি। আমার গাড়িতে যদি কারো জায়গা লাগে, দুইজন উঠতে পারো। চুপচাপ ড্রাইভে মন বসে না। আর দুইজন সঙ্গী পেলে তেলের খরচটাও কমে যায়।”
তার বলা শেষ হতে না হতেই চারপাশে আবার সেই থমথমে নিস্তব্ধতা। কেউ কিছু বলছে না। মুখের ভেতরে কথা আটকে আছে যেন।
তানভীর বলল, “এইভাবে ভাগ হয়ে যাওয়া… মানে, আমাদের তো প্ল্যান ছিল একসাথে যাওয়ার। হ্যাটিসবার্গ ফেরত যাই আজকে না হয়। পরের সপ্তাহে ভাই সুস্থ হলে আবার প্ল্যান করা যাবে।”
সাজিদ গলা নামিয়ে বলল, “অচেনা কারো গাড়ি… মরুভূমির ভিতর দিয়ে? নেটওয়ার্কও তো থাকবে না। আমি এই রিস্ক এ নাই ভাই।”
মাইশা তখন ফোনে গুগল ম্যাপে ক্লিনিকের লোকেশন খুঁজছে—তার মন অন্য জায়গায়।
মেয়েটা একটু ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “No pressure,” এবং হাঁটা শুরু করল নিজের গাড়ির দিকে।
আমি তখন বসা অবস্থায়ই পায়ের জুতা খুলতে খুলতে বেশ দৃঢ় স্বরে বলে উঠলাম, “আমি যাব।”
মেয়েটা থেমে পেছন ফিরে তাকাল। তার চোখে ভ্রু উঁচু করে একটা খুশির ছায়া। তখনই পেছন থেকে একদম নিরব, নিখুঁত একটা গলা ভেসে এল—“একটা সিট থাকলে, আমিও যাব।” ঘুরে দেখি, নাজিয়া।
ভ্যানের এসি থেকে বেরিয়েই হুডি খুলে ফেলেছে, চোখে সানগ্লাস, এক হাতে ব্যাগ, আরেক হাতে চুল পেছনে সরিয়ে রেখেছে। মুখে না আছে কোন ভয়, না নাটক—শুধু একটা স্থিরতা। যেন সিদ্ধান্তটা ঠিক আগেই নিয়েছিল।
মাইশা ফোন থেকে তার কথাটা শুনেই মুখ তুলে তাকিয়েছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেই বলল, “তুই… সিরিয়াসলি?” নাজিয়া উত্তর দিল না।
নতুন মেয়েটা এবার একটা ছোট হাসি দিয়ে বলল, “Then let’s go.”
আমি মুচকি হাসলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম “এত পথ যেতে রাজি করিয়ে ফেললে, নামটা তো জানা উচিত এখন।” মেয়েটা তার ছোট হাসিটা ধরে রেখেই বলল “আমি জেসিকা। আমাকে তুমি জেসি বলে ডাকতে পার।”
এভাবেই, একটা গ্যাস স্টেশনের কনক্রিটের ছায়ায়, হঠাৎ তিনজন মানুষ—এক বাঙালি ছেলে, এক রহস্যময় মেয়ে, আর এক বোহেমিয়ান আমেরিকান—একসাথে রওনা দিল নতুন যাত্রায়।
মোয়াব এখনও বহু দূরে, কিন্তু এবার প্রথমবার মনে হচ্ছিল—এই রোডট্রিপটা সত্যিই শুরু হয়েছে।