নীরবতার ভেতর তিনজন

ফারহান গাড়িটা ধীরে ধীরে ধানমন্ডির লেন ছেড়ে মূল রাস্তায় তুলল। রাতের ঢাকা অন্যরকম—দিনের কোলাহল তখনো মরে যায়নি, কিন্তু তার ভেতরে এক ধরনের শিথিলতা নেমে আসে। স্ট্রিটলাইটের আলো কাচে ভেঙে পড়ে, গাড়ির ভেতর ছায়া–আলো খেলতে থাকে।

তার মাথার ভেতর কিন্তু শান্তি নেই।

লোলার মুখটা বারবার ভেসে উঠছে। কপালের টিপ। সিঁথির লাল সিঁদুর। সেই শান্ত অথচ অটল দৃষ্টিটা, যেটা আজ সন্ধ্যায় সে ফ্ল্যাটে দেখেছিল। ফারহান নিজেকে বোঝাতে চেয়েছিল—এটা নতুন কিছু না। একজন বাড়িওয়ালা আর ভাড়াটিয়ার স্ত্রীর মধ্যে অপ্রয়োজনীয় আকর্ষণ—ঢাকায় নতুন নয়। সে বহু বছর ধরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছে।

কিন্তু আজকের রাতটা আলাদা ছিল।

প্রতীমের উপস্থিতি সবকিছু বদলে দিয়েছে।

ফারহান গাড়িটা পার্কিংয়ে থামাল। ইঞ্জিন বন্ধ করতেই চারপাশের শব্দ যেন এক লহমায় দূরে সরে গেল। শুধু নিজের শ্বাসের শব্দ, বুকের ভেতরের চাপা উত্তেজনা। শরীরটা স্থির থাকতে চাইছিল না।

সে চোখ বন্ধ করল।

প্রথমে লোলাই এল কল্পনায়—যেভাবে সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, আলো তার কাঁধে পড়ে নরম রেখা তৈরি করছিল। তার শরীরের ভাষা—সাহসী নয়, কিন্তু আত্মবিশ্বাসী। ফারহানের ভেতরে সেই পুরোনো, পরিচিত কামনাটা নড়ে উঠল।

কিন্তু কল্পনা সেখানে থামল না।

হঠাৎ করেই প্রতীম ঢুকে পড়ল ছবিটায়। যেভাবে সে ঘরে ঢুকে থেমে গিয়েছিল। তার চোখে সেই মুহূর্তের দ্বিধা—না পুরো রাগ, না পুরো বিস্ময়। ফারহান অবাক হয়ে টের পেল, এই উপস্থিতি কল্পনাকে ভেঙে দেয়নি। বরং আরও তীব্র করেছে।

সে চোখ খুলে তাকাল। নিজের প্রতিফলন কাচে অস্পষ্ট।
“এটা কী হচ্ছে?” সে নিজেকে প্রশ্ন করল।

তার কামনা আজ সোজা পথে হাঁটছে না। লোলাকে ঘিরে যে আকর্ষণ, তার পাশে এখন প্রতীমের একটা আলাদা জায়গা তৈরি হয়ে গেছে—প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নয়, বরং সমান্তরাল এক টান হিসেবে। এই উপলব্ধিটাই তাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিল।

ফারহান দীর্ঘদিন ধরেই জানত, সে নিজের ভেতরের অনেক প্রশ্ন এড়িয়ে গেছে। কাজ, পরিবার, সামাজিক কাঠামো—সবকিছুর ভেতর নিজেকে গুছিয়ে রেখেছে। কিন্তু আজ, একটা ফ্ল্যাটের নিঃশব্দ সন্ধ্যা সেই গুছিয়ে রাখা মানচিত্রটা এলোমেলো করে দিয়েছে।

সে গভীর শ্বাস নিল। শরীরের ভেতরের উত্তেজনা এখন আর কেবল শারীরিক নয়—এটা মানসিক। বুদ্ধির সঙ্গে লড়াই করছে।

গাড়ির দরজা খুলে সে বাইরে এল। পার্কিংয়ের বাতাস গরম, ভারী। ঢাকার রাত তার শরীরের সঙ্গে লেগে থাকছে।

ফারহান পরের কয়েকদিন ইচ্ছা করেই ফ্ল্যাটে যায়নি। কাগজপত্র, মেরামত—সবকিছু ফোনেই সেরে ফেলেছে। কিন্তু দূরে থাকলেও লোলার উপস্থিতি তার মাথা ছেড়ে যায়নি। আর প্রতীম—সে যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

সে খেয়াল করল, সে ইচ্ছে করে প্রতীমের কথা ভাবছে। তার কণ্ঠ কেমন হবে। তার চলাফেরা। সে কীভাবে কথা বলে। এই কৌতূহলটা তাকে অস্বস্তিতে ফেলছিল, কিন্তু সে এটাকে দমন করল না।

এক সন্ধ্যায়, হঠাৎ করেই লোলার ফোন এল।

“একটু আসতে পারবে?” তার কণ্ঠ শান্ত। “বাথরুমের একটা সমস্যা।”

ফারহান ফোনটা কেটে অনেকক্ষণ বসে রইল। এটা কি অজুহাত? সম্ভবত। কিন্তু সে জানত, সে না বলবে না।

ফ্ল্যাটে ঢুকতেই পরিচিত গন্ধ—ধূপ, রান্নার হালকা গন্ধ, আর লোলার শরীরের সেই আলাদা উপস্থিতি। সে আজ সাধারণ শাড়ি পরেছে। সিঁথির সিঁদুর আগের মতোই স্পষ্ট।

প্রতীম তখন বাসায় নেই।

এই তথ্যটা ফারহানের শরীরে এক ধরনের দ্বৈত প্রতিক্রিয়া তৈরি করল—হালকা স্বস্তি, আর অদ্ভুত এক শূন্যতা।

বাথরুমের কাজ খুব ছোট ছিল। কিন্তু ফারহান তাড়াহুড়ো করল না। তার চোখ বারবার লোলার দিকে যাচ্ছিল। লোলাও সেটা টের পাচ্ছিল—কিন্তু কিছু বলছিল না।

“তুমি কেমন আছ?” সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।

এই সাধারণ প্রশ্নটাই ঘরের বাতাস বদলে দিল।

লোলা একটু থামল। তারপর বলল, “অনেক কিছু ভাবছি।”

ফারহান আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। সে জানত, কিছু কথা প্রশ্নে নয়—অপেক্ষায় আসে।

এইবার, অদ্ভুতভাবে, প্রতীমের অনুপস্থিতিই ফারহানের মাথায় তার উপস্থিতি আরও জোরালো করে তুলল। লোলার পাশে দাঁড়িয়েও সে বুঝতে পারছিল—এই গল্পে প্রতীম কেবল বাধা নয়। সে নিজেই গল্পের অংশ।

এই উপলব্ধিটা তাকে ভয় দেখাল। আবার টানলও।

ফারহান সেদিন রাতে আবার গাড়িতে বসে ছিল। কিন্তু এবার কল্পনাটা বদলেছে। লোলা আর প্রতীম—দুজনই সেখানে। কেউ কারো জায়গা দখল করছে না। বরং তিনটি উপস্থিতি একে অপরকে টেনে ধরছে।

সে বুঝতে পারছিল—এটা আর হঠাৎ উত্তেজনা নয়। এটা একটা দরজা খুলে যাওয়া।

ফারহান প্রথমবার নিজের কাছে স্বীকার করল—সে শুধু লোলাকে চায় না। সে এই জটিল সমীকরণটাকেই চায়। এই অনিশ্চয়তা, এই টান, এই তিনজনের মধ্যে তৈরি হওয়া নীরব চৌম্বকত্ব।

রাতের শেষে সে সিদ্ধান্ত নিল—পিছিয়ে যাবে না। তাড়াহুড়োও করবে না।

এই গল্প ধীরে এগোবে।

আর সে তার প্রতিটা মুহূর্ত অনুভব করতে চায়।

ফারহান বুঝতে পারছিল—আর এড়ানো যাবে না।

লোলার ফোনের পরের কয়েকদিন সে অস্বাভাবিকভাবে সজাগ ছিল। প্রতিটি কল, প্রতিটি মেসেজে তার মনোযোগ বেড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু যেটা সে সবচেয়ে বেশি টের পাচ্ছিল, সেটা হলো—প্রতীমের নাম উচ্চারিত হলেই তার ভেতরে একটা আলাদা সাড়া জাগছে।

এই সাড়া লোলাকে ঘিরে নয়। এটা সরাসরি।

এক শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রতীম নিজেই ফোন করল।

“একটু সময় পেলে আসতে পারো?”
তার কণ্ঠে কোনো অভিযোগ ছিল না। ছিল না রাগও। শুধু একটা স্থিরতা—যেটা ফারহান আগের রাতে কল্পনায় শুনে ফেলেছিল।

ফারহান ফোন কেটে অনেকক্ষণ বসে রইল। বুকের ভেতর সেই চাপা আগুনটা আবার নড়ে উঠল—কামনার নয়, বরং সংঘর্ষের। নিজেকে সামলে সে ফ্ল্যাটের দিকে রওনা দিল।

প্রতীম দরজা খুলল। ঘরে ঢুকতেই ফারহান লক্ষ করল—লোলা আজ ভেতরের ঘরে। ইচ্ছে করেই সরে গেছে। এই সিদ্ধান্তটাই পরিস্থিতিটাকে আরও নগ্ন করে তুলল।

ড্রয়িংরুমে দু’জন পুরুষ মুখোমুখি বসল।

কয়েক সেকেন্ড কেউ কথা বলল না।

ফারহান প্রথমবার কাছ থেকে প্রতীমকে দেখছে—আলোয়, নিরপেক্ষ অবস্থায়। তার মুখে ক্লান্তি আছে, কিন্তু ভাঙন নেই। চোখে প্রশ্ন আছে, কিন্তু দুর্বলতা নয়। এই সংযত শক্তিটাই ফারহানের ভেতরের টানকে আরও স্পষ্ট করে তুলল।

“সেদিন…” প্রতীম কথা শুরু করল, আবার থামল।
“আমি জানি,” ফারহান শান্তভাবে বলল। “সব পরিষ্কার ছিল না।”

এই স্বীকারোক্তি ঘরের বাতাস বদলে দিল।

প্রতীম গভীর শ্বাস নিল। “আমি ভেবেছিলাম রাগ করব। কিন্তু সেটা হয়নি।”

এই কথাটাই ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক।

ফারহান চেয়ারের পেছনে হেলান দিল। সে বুঝতে পারছিল—এই মুহূর্তে একটাও ভুল শব্দ পরিস্থিতিটাকে ভেঙে ফেলতে পারে। তাই সে সত্যের কাছেই থাকল।

“আমিও নিজেকে বুঝে উঠতে পারছি না,” সে বলল। “এটা শুধু লোলাকে নিয়ে নয়।”

প্রতীম তাকিয়ে রইল। চোখ সরাল না।

এই নীরবতার মধ্যেই ফারহান টের পেল—তার কথা শোনা হচ্ছে। বিচার করা হচ্ছে না।

“আমি সেদিন তোমার দিকে তাকিয়ে…,” ফারহান থামল। “নিজেকে চিনতে পারিনি।”

প্রতীম হালকা হাসল। কৌতুক নয়—স্বীকৃতি।
“আমিও,” সে বলল।

এই একটা শব্দ—দুটো মানুষকে একসাথে দাঁড় করিয়ে দিল, অদ্ভুত এক সমতলে।

লোলা চা নিয়ে এল। টেবিলে রেখে কোনো কথা না বলে ফিরে গেল। কিন্তু তার উপস্থিতি ছিল স্পষ্ট—এই ঘরটা সে ছেড়ে দেয়নি, শুধু জায়গা করে দিয়েছে।

প্রতীম চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
“আমি ভাবছি… এই টানটা যদি অস্বীকার করি, তাহলে মিথ্যে হবে।”

ফারহানের বুকের ভেতর একটা ধাক্কা খেল।

এই কথাটা সে নিজে বলার সাহস পায়নি।

“আমি জানি না এর মানে কী,” প্রতীম আবার বলল। “কিন্তু আমি এটাকে ভয় পাচ্ছি না।”

ফারহান চেয়েছিল কিছু বলতে। কিন্তু তার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। এতদিনের চাপা প্রশ্নগুলো যেন হঠাৎ ভাষা পেয়ে যাচ্ছে—অন্য কারো কণ্ঠে।

সে শুধু মাথা নাড়ল।

এই মাথা নাড়াটাই ছিল একধরনের চুক্তি—অঘোষিত, কিন্তু শক্ত।

রাত বাড়ল। কথাবার্তা আর সরাসরি আকর্ষণের কথা ঘোরেনি, কিন্তু সব কথার নিচে সেটা উপস্থিত ছিল। তারা কাজের কথা বলেছে, শহরের কথা, এমনকি ছোটখাটো হাসিও হয়েছে। কিন্তু এই স্বাভাবিকতার ভেতরেই ছিল নতুন সমীকরণের উত্তেজনা।

ফারহান লক্ষ করল—প্রতীমের দিকে তাকানো এখন আর অজান্তে নয়। সে নিজেই সেই দৃষ্টি বেছে নিচ্ছে। আর প্রতীম—সে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিচ্ছে, পালাচ্ছে না।

একসময় ফারহান উঠে দাঁড়াল। যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।

প্রতীমও উঠল।

দু’জনের মাঝে অল্প দূরত্ব। খুব কম। খুব বেশি নয়। কিন্তু যথেষ্ট।

“আমরা তাড়াহুড়ো করছি না,” প্রতীম বলল।
“না,” ফারহান জবাব দিল। “একদমই না।”

এই কথার মধ্যে কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না। কিন্তু একটা দিকনির্দেশ ছিল।

ফারহান বেরিয়ে এলে লোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। সে কিছু জিজ্ঞেস করল না। শুধু তাকাল।

এই তাকানোর মধ্যেই ছিল সব প্রশ্ন আর সব উত্তর।

ফারহান বুঝতে পারল—লোলা এই গল্পের কেন্দ্রবিন্দু ঠিকই, কিন্তু নিয়ন্ত্রক নয়। সে পথ খুলে দিয়েছে, হেঁটে যেতে হবে অন্যদেরই।

গাড়িতে বসে সে আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকাল। সেখানে আর বিভ্রান্তি নেই। আছে উত্তেজনা—কিন্তু তা বিশৃঙ্খল নয়।

এই প্রথম সে জানত—তার কামনা শুধু শরীরের নয়। এটা পরিচয়ের।

ঢাকার রাত গাড়ির চারপাশে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছিল।

আর ফারহান জানত—এই গল্প এখানেই থামবে না।