বিরাজের জীবন কথা – ২৭

গত পর্বের পরে –

“ওটা খুব সুন্দর কাহিনী! অন্যদিন বলবো!

” না না এখন বলো কত রোমান্টিক মহল ভালো লাগবে”

“ওকে বাবা,…… তখন আমরা আর তোমার নয়ন ভাইয়া একই ক্লাসে পড়তাম। মাইলস্টোন কলেজে একাদশে-দ্বাদশে থাকতে তোমার ভাইয়া ছবি আঁকতো অনেক! তার কাছে একটা ছোট খাতা ছিলো যাতে সে লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু আঁকত। কাউকে দেখাতো না। ইভেন তার বন্ধুদেরকেও না। ওর খাতাটা নিয়ে অনেক চর্চা ছিল ক্লাসে। কেউ আসছে দেখলেই ও খাতা গায়েব করে ফেলতো। তো এমনি একদিন হটাৎ স্মৃতিই তার ড্রয়িং খাতাটা টেবিলের নিচে শেষ কোনায় পড়ে থাকতে দেখে কৌতুহলি তুলে নেয় আর আমাকে দেখায়। তোমার ভাইয়ার ব্যাগ থেকে ভুলে পড়ে গিয়েছিল।

বাসায় ফিরে আসার পর আমি আর স্মৃতি একসাথে খাতাটা দেখতে বসি। কারণ খাতাটা নিয়ে ক্লাসের সবার মধ্যে একটা জল্পনাকল্পনা বাঁধা ছিল। কেউই জানতো কি এমন আঁকে বসে বসে। সো আমরা আমার রুমে বসে খাতাটা খুললাম। খাতাটা দেখেতো আমি আর স্মৃতি অবাক হয়ে যাই। আর আমি যেন আকাশ ভেঙে পড়ি! পুরো খাতায় জুড়ে শুধু আমার ছবি আঁকা। খুবই সুন্দর করে করে প্রতিটি ছবির অপর পাতায় ছবির সম্পর্কে লেখা। কোন দিনের, কোথায়, আমাকে কিভাবে দেখলো সে, আমাকে নিয়ে তার ফিলিংস এবং আমাকে নিয়ে তার সব স্বপ্ন সব লেখা ছিলো। এককথায় তোমার ভাইয়া আমার নিশ্চুপ প্রেমিক ছিল।

যে কলেজে আমাদেরকে সবাই লেসবিয়ান ভাবতো সেখানে এমন নিস্তব্ধ প্রেমিকের খাতায় আমার স্কেচ আর লেখাগুলো আমাকে বিচলিত করে তুললো। তোমার ভাইয়া আট-দশটা সাধারণ ছেলের মতোই ছিল, লেখাপড়া, বন্ধুদের সাথে আড্ডা এগুলোই, তবে মেয়েদের সাথে তেমন কথা বলেতোনা। তাই তার সম্পর্কে কোন আজেবাজে বা অবাক করার মতো কিছু ছিলনা ক্লাসে। তার উপরে আমরা কখনো কথা বলিনি। ক্লাসমেট হিসেবে মুখ আর নাম পরিচিত আর কি। আমরা সপ্তাহের জন্য খাতাটা লুকিয়ে ফেলি। তার লেখাগুলো আর স্কেচ গুলো পুরো পড়ার পর সেই পুরো সপ্তাহ আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল তার লেখা লাইনগুলো। আমি আর স্মৃতি লুকিয়ে লক্ষ্য করলাম খাতা হারানোর পর তোমার ভাইয়া অলমোস্ট দিশেহারা হয়ে গেছে।

পাঁচ দিন ক্লাসের প্রতিটি সেকেন্ড ওর চেহারা দেখে খুব খারাপ লাগতো। ও যেন খাতাটা হারিয়ে সর্বশান্ত। ওই পুরো পাঁচটা দিন ওর চেহারায় সর্বক্ষণ চিন্তার চাপ থাকতো। ও সবার কাছে গিয়ে গিয়ে খাতাটা সম্পর্কে জানতে চাইলো কিন্তু সবাই তাকে হতাশ করলো। কিন্তু ও আমাদের দুইজনের কাছে জিজ্ঞেস করল না! অপরদিকে তার লেখা লাইনগুলোতে আমার প্রতি তার ভালবাসা আমাকে জ্বালিয়ে মারছিল। যেহেতু স্মৃতি জানতো আমি লেসবিয়ান না তাই ও আমার কাছে জানতে চাইলো আমি কি চাই। স্মৃতি পুরো সাহায্য করে আমি কি চাই, আর আমিও তোমার ভাইয়ার উপর মন দিয়ে বসি।

পরের সপ্তাহের প্রথম স্কুলের দিন রবিবারে স্মৃতি আমাকে বিল্ডিংয়ের ছাদে গিয়ে অপেক্ষা করতে বলে ও ক্লাসে চলে যায়। প্রায় পাঁচ মিনিট পর তোমার নয়ন ভাইয়া আর স্মৃতি ছাদে আসে। নয়ন আমাকে সেখানে দেখে একদম অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। স্মৃতি ওকে আমার কাছে আসতে বললো। ও আস্তে আস্তে আমার সামনে এসে দাড়িয়ে রইলো চুপচাপ, ও জানেনা কি হয়েছে, ওর এক কাঁধে স্কুল ব্যাগ। স্মৃতি ছাদের দরজার সামনে দাঁড়ালো।

আমি এক পা সামনে এগোতেই ও এক পা পিছনে চলে গেল ভয়ে, বুঝতে পারছিলাম ওর মনের ভয় আর আমার উপস্থিতি ওকে পিছনে যেতে বাদ্য করছে। আবার ও তাই হলো! আমি আবার পা বাড়ালাম ও পা পিছিয়ে নিলো।

“তুমি বারবার পিছনে যাচ্ছ কেন? ”

” ক…ক. কই নাতো? ” নয়ন বললো।

আমি জিজ্ঞেস করলামঃ শুনলাম তোমার কিছু একটা হারিয়ে গেছে আর সবার কাছে খুঁজেও পাওনি।

“ও ও ওও ওও আমার একটা স্কেচ বই হারিয়ে গেছে” নয়ন আমতা আমতা করে বললো।

“আমাদের কাছে তো খুঁজনি! ”

এটার উওর দিতে পারলােনা নয়ন!

“কেমন দেখতে বইটা”

“ও ও ওও… তেমন কিছুনা ৪/৬ স্কেচ বই! খুব পারসোনাল ছিল তো তাই”

“পারসোনাল বলতে ঠিক বুঝলাম না! কি ধরনের স্কেচ বই?”

” ওটা… ওটা না অনেক পুরাতন। আগের কিছু ছবি আঁকা তো তাই…. অ…. অনেক বেশি পারসোনাল! ”

“ওহ আচ্ছা! আচ্ছা দেখতো এটা কিনা” বলে খাতাটা পিছন থেকে তার সামনে ধরলাম।

আমি পিছন থেকে খাতাটা বের করে সামনে ধরতেই ওর কাঁধ থেকে ব্যাগটা ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে গেল।

ও কখনো কল্পনাও করেনি আমার হাতেই তার খাতাটা থাকবে।

“এটাইতো খুঁজছিলে গত সাতদিন না? ”

নয়ন কোন উওরই দিলোনা।

আমি জিজ্ঞেস করলামঃ “খাতায় আঁকা ছবি, অপর পাতায় লেখা লাইনগুলো কি সত্যি!”

আবারও নয়ন কোন উওর দিলো না। কারণ ও ভয় পাচ্ছিলো।

“তাহলে কখনো বলনি কেন?”

“সবাই বলে তুমি আর স্মৃতি একে অপরকে ভালবাসো তাই বলার সাহস পাই নি!”

তখনই স্মৃতি পিছন থেকে জোরে বলে উঠলোঃ- মিশু লেসবিয়ান না ও স্টের্ইট।

নয়ন কথাটা শুনে আমার দিকে এক নজরে পাগলের মতো জিজ্ঞেসা সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

আমি মাথা উপর নিচে করে বললামঃ “হুম”

কথাটা শুনে তোমার নয়ন ভাইয়ার চোখের কণা দিয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরছিল কিন্তু ও নিজেও বুঝতে পারলাে না।

“তুমিকি আমাকে কি কিছু বলতে চাও” জিজ্ঞেস করলাম।

নয়ন আমাকে শেষ পেইজের লাইনটা পড়তে বললো।” তুমি কি শেষের লাল লাইনটা একটু পড়বে!”

আমি পড়লাম-
“আমি কি আদৌ তাকে মনের কথা বলতে পারবো?”

ও উওরের জন্য আমার চোখে চোখে তাকিয়ে রইলো!

“হুম বলতে পারো” আমি বললাম।

ও সাথে সাথে হাটু গেড়ে বসে ব্যাগ থেকে একটা লম্বা বক্স বের করে তার ভিতর থাকা গোলাপ ফুল নিয়ে আমাকে প্রপোজ করলো। তার বলা প্রতিটা লাইন এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে! একটু বাজে আর বেশি ইমোশনাল ছিল কারণ দুই বছরের জমানো ব্যাথাতো তাই কিন্তু ভীষণ কিউট ছিলো লাইনগুলোঃ

“প্রথম দিনের ক্লাসে ঢুকতে সময় সেই এক পলকে দেখা কিউট চেহারার জন্য দুই বছর লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে থাকা আমি যদিও তাকে পাওয়া অসম্ভব জানতাম তা সত্ত্বেও মন বুঝতো না। জানিনা এটাও সত্যি নাকি কল্পনা, তবে আজও জানতে ইচ্ছে করে, সেই কিউট চেহারাটা কি আমার আগামী ৪/৬ প্রতিটা খাতার প্রতিটা পাতায় আমায় সঙ্গী হবে।”

নয়ন কাঁদতে কাঁদতে লাইনগুলো বলে শেষ করলো। ও কান্না থামাতে পারছেনা।

আর তার এই কথাগুলো শুনে আমি নিজের কান্না আটকাতে পারলাম না৷ কাঁদতে কাঁদতে তাকে জড়িয়ে ধরলাম।

বাস এভাবেই আমি আর তোমার নয়ন ভাইয়া আজ লাইফ পার্টনার।

আমিঃ খুবই কিউট লাভ স্টোরি তোমাদের।

ভাবিঃ হুম আমি জানি!